সোমবার দুপুর আড়াইটার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরের পথে পাড়ি দিচ্ছি একের পর এক জট। আকাশে থেমে থেমে বৃষ্টিতে যানজট তীব্রতর আকার ধারণ করেছে জলমগ্ন সড়কে।
এখান থেকে উত্তর চট্টগ্রামের অনেকগুলো রুটে বাস, টেম্পু চলে। সবার ফ্রি স্টাইল অবস্থা। রাস্তা দখল করে কে কার আগে যাবে, চলছে সেই উৎকট প্রতিযোগিতা। ট্রাফিক বিভাগের কাউকে দেখা গেলো না চরম পরিস্থিতিতেও। আধ ঘণ্টায় অক্সিজেনের জট থেকে বের হওয়া সম্ভব হলো। সাধারণত যা দশ মিনিটে পাড়ি দেওয়ার কথা।
সামনে তখনো ভয়ংকর জট অপেক্ষমাণ। বায়েজিদ পেরিয়ে বাস টেকনিক্যাল মোড়ে থমকে গেল। সামনে প্রায় এক কিলো গাড়ির সারি। ষোলশহর ২নং রেলগেট পর্যন্ত বাস, ট্রাক, রিকশা, টেম্পু, সিএনজির স্তব্ধ মিছিল। এলাকাটা নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চলের অংশ। শত শত ট্রাক পুরো রাস্তার দু’পাশের অধিকাংশ জায়গা দখল করে মাল ওঠা-নামার কাজ করছে।
সামনে ষোলশহর ২নং রেলগেটের পরই ফ্লাইওভার। কিন্তু রেলগেটের আশপাশ এলোপাথাড়ি যানবাহনে পূর্ণ। জটের প্রধান কারণ বিশৃঙ্খলা। মেঘলা আকাশের গুমোট আবহাওয়ায় হর্ন, চেঁচামেচি, চিৎকার, হট্টগোলে চারপাশে নরক গুলজার। চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থার চরম বিপর্যস্ত চিত্র নিয়ে ক্ষুব্ধ কথার রেশ যানজটে নাকাল নগরবাসীর মুখে মুখে। ক্ষোভ সিএনজি ও রিকশাচালকদের প্রতিও লক্ষ্য করা গেলো। নিয়ম না মেনে অবাধে জটলা করে যানজট বাড়াচ্ছে আর দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া নিচ্ছে চালকরা। নাগরিক দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে টাকা কামাই করতে সত্যিই বেপরোয়া পরিবহন সেক্টরের লোকজন।
জটাক্রান্ত অবস্থায় ধেয়ে এলো মুষলধারার বৃষ্টি। দেখতে দেখতে জল জমলো রাস্তায়। পিঁপড়ার মতো ঠেলে ঠেলে ষোলশহর পেরিয়ে পূর্বকোণ অফিসের সামনে দিয়ে জিইসি মোড় অবধি আসতেই রাস্তা টুইটুম্বুর। খানিক বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামের রাস্তাগুলোতে চোখের সামনে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে সয়লাব হয়ে যেতে দেখলাম। বৃষ্টির মধ্যে লালখান বাজার মোড়ে আধ ভেজা হয়ে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহর পর্যন্ত এক ঘণ্টার পথ পেরুলাম তিন ঘণ্টায়! জল ও যানজটের জন্য স্বাভাবিক সময়ে দুই তিন গুণ সময় পথে পথে নষ্ট হচ্ছে চট্টগ্রামের নাগরিকদের।
লালখান বাজারের ইস্পাহানি মোড় থেকে কোনক্রমে বৃষ্টি ভেঙেই স্টেডিয়ামের সামনে কাবাবের দোকানগুলোর একটিতে পৌঁছুলাম। জাদুঘর বিশেষজ্ঞ মতিয়ার রহমানের সাথে পূর্বনির্ধারিত আলাপ ও ইফতারের কথা থাকায় আসতেই হলো। ভদ্রলোকও এসেছেন আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকা থেকে প্রায়-ভিজে। সেখানকার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক বাড়ির একতলায় পানি। পথ-ঘাট জলপূর্ণ। সকালে ওদিক দিয়ে ভাটিয়ারির বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যাওয়ার সময় আমি নিজেই সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখেছি। কাদাপানিতে পথ পিচ্ছিল। সিএনজিতে বসেও জামা-জুতা ভদ্রস্থ রাখা দুস্কর হচ্ছিল জলকাদার ঝাপ্টায়। ষোলকবহর, বাদুরতলা, বিবিরহাট, বহদ্দারহাটসহ নগরের নানা জায়গায় জলাবদ্ধতাজনিত নানা সমস্যার খবর পাওয়া গেল।
প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঘাঁটি করতে চেয়েছিল আরাকান, আরব, পর্তুগিজ, বাংলার সম্মিলিত সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী জনপদ চট্টগ্রামে। জোব চার্নক প্রায়-জোর জরবদস্তি করে কোম্পানিকে রাজি করায় কলকাতাকে বেছে নেওয়ার জন্য। জলাশয় সদৃশ্য কলকাতা ক্রমে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহানগর হয়েছে। আর সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম? ক্রমেই পিছিয়ে গেছে।
তবুও ইংরেজরা পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপের সাথে তাল মিলিয়ে পাহাড়তলী, আন্দরকিল্লা, সিআরবি এলাকা সাজিয়ে ছিলেন। ষাট, সত্তর দশকের চট্টগ্রাম কাঠের দোতলায় 'চিম্বুক' নামের রেস্টুরেন্ট, বার্মা রাজু হোটেল আর উচ্চাবচ ভূমিরূপের কারণে অনেকের কাছেই প্রাচ্যের ভেনিস বা রোমের প্রতিরূপ ছিল। পাহাড় কেটে, নিসর্গ নষ্ট করে প্রতিদিন চ্ট্টগ্রামকে বিপন্ন করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অক্টোপাশের বহু হন্তারক হাত চট্টগ্রামকে গলা টিপে ধরছে। ত্রস্ত নগরের এখন করুণ দশা।
যে কোন নগরের জন্য সমন্বিত আর্বান প্ল্যান থাকার কথা থাকলেও চট্টগ্রামের জন্য তেমনটি শোনা যায় নি। দুর্যোগ ও সমস্যা প্রতিহত করে নগরের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান কি চট্টগ্রামের আছে? থাকলে অপরিকল্পিত নানা পদক্ষেপের কারণে চট্টগ্রামকে আক্রান্ত হতে হতো না। চট্টগ্রামকে হতে হতো না বিকাশরহিত বন্দিনী নগরী!
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৭
জেডএম/