আমরা জানি, ধর্ম ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। ধর্মে প্রভাব যে সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান; তেমনি সংস্কৃতির প্রভাবও ধর্মের ক্ষেত্রে অলক্ষ্যণীয় নয়।
যদিও ঈদ একটি নিখাদ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তথাপি এতে সংস্কৃতির নানা বিষয় এসে যুক্ত হয়েছে। এবং লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এতে একটি পরিবর্তনশীল ধারার বিকাশ হচ্ছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বা পঁচিশ বছর আগের ঈদ এবং বর্তমানের ঈদ আয়োজন ও উদযাপনে অনেকাটাই বদলে গেছে। বিশেষত, এখন যে বিশ্বায়নের তীব্র পরিস্থিতি চলছে, তাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির প্রবল দাপট এসে হামলে পড়ছে বিশ্বের দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং বাংলাদেশের ঈদের নানা আয়োজনে বহু-বিচিত্র সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চই প্রাধান্য পাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সবগুলোই ভালো এবং গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবর্তনের স্রোতে মাথা নুইয়ে না দিয়ে এর ভালো-মন্দ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবেচনা রাখাটাও জরুরি।
মুসলমানদের উৎসব প্রধানত দুটি। ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। সাধারণ ভাষায় বড় ঈদ ও ছোট ঈদ। কিংবা বকরি ঈদ ও কোরবানি ঈদ। ঈদ-উল-ফিতরের মূল চেতনাটি হলো এক মাস কঠোর সিয়াম বা কৃচ্ছ্বতা সাধনের পর আনন্দে শরিক হওয়া। রোজাদাররা রমজান শেষে ঈদের অনাবিল আনন্দে রহমত, মাগফিরাত ও নাযাত প্রাপ্তির মাধ্যমে তৃপ্তির উৎসব উদযাপন করবেন ঈদের দিনে, এটাই ধর্মের বিধান। এতে উৎসবের সূত্র ধরে উন্নত খাবার আর পোশাকের প্রসঙ্গ আসে। যেসব ট্র্যাডিশনাল বাঙালি খাবার এবং মুসলিম ঐতিহ্যের রন্ধন ঈদের জন্য অপরিহার্য ছিল, সেই খাদ্যাভাস বদলাচ্ছে। খাদ্য তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য। ফাস্টফুড দাপট দেখাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পাণীয় বা ড্রিংসের প্রচলন হচ্ছে। পোশাকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ড ও নাম যুক্ত হচ্ছে।
ঈদের সাংস্কৃতিক উদযাপনের মধ্যে আগেকার দিনগুলোতে ঐতিহ্যের অনুসরণে প্রধানত ছিল কবর জেয়ারত, পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়দের বাড়ি বেড়ানো এবং বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলো পড়ার রেওয়াজ। এখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার রমরমা অবস্থায় মানুষের কার্যক্রম বদলে গেছে। শত শত চ্যানেল ঈদ উপলক্ষে পাঁচ দিন বা সাত দিন অনুষ্ঠানমালা সাজাচ্ছে। চলচ্চিত্র, নাটক, বিনোদন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ হরেক উপাচারে চ্যানেলগুলোর আয়োজন উপচে পড়ছে।
ঈদে আর এখন সামাজিক-ধর্মীয় কাজে মানুষকে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ঘরমুখো এবং টিভি-পর্দায় মনোযোগী। ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ, কুশলাদি বিনিময়, সম্পর্ক দৃঢ়করণের কাজটি পিছিয়ে যাচ্ছে। কৃচ্ছ্বতার স্থান দখল করছে বল্গাহীন ভোগ ও উদ্দাম বিনোদন। তরুণ-তরুণীদেরকে তো হাতের কাছে পাওয়াই যাচ্ছে না। তারা ফেসবুক এবং ইন্টারনেট সংযোগ হাতের আইফোন বা এন্ড্রয়েডে নিয়ে সমাজ-সংসার থেকেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঈদ উপলক্ষ্যে সামাজিক মেলামেশায় ভাটা পড়ছে। সমাজের বুননও শিথিল হচ্ছে এ কারণে। সবাই যেন বাস্তব সমাজ ছেড়ে ভার্চুয়াল সমাজের অধরা বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে।
সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে যারা সমাজ, মানুষ, সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে কাজ করছেন, তারা বিষয়গুলোকে আরো ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। চলমান পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোকে চিহ্নিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। ধর্ম নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারাও ধর্ম আর সংস্কৃতির নানা প্রায়োগিক দিকের ব্যাখ্যা দিয়ে এসবের ভালো-মন্দ সম্পর্কে বলতে পারবেন। নিশ্চয় বিচিত্র ও বহুমাত্রিক পরিবর্তনশীলতা তাদেরও নজরে এসেছে এবং তারাও বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রেও এসব ভাবনা জোরদার হওয়া দরকার। নইলে খারাপ পরিবর্তন অচীরেই আমাদের আচ্ছন্ন করবে। সেই রাহু গ্রাস থেকে বের হওয়াও তখন কষ্টকর হবে।
স্মৃতি ও ইতিহাসের নিরিখে আরেক ধরনের তুলনা চলতে পারে। পরিবর্তন সম্পর্কে আচঁ পাওয়া যেতে পারে আগের দিনের ঈদ এবং বর্তমান দিনগুলোর ঈদের মধ্যে। এই তুলনা খুবই নস্টালজিক ও স্মৃতিময়। বয়স, শিক্ষা ও সামাজিক স্তরবিন্যাস ভেদে এই তুলনা বিভিন্ন হবে। তবুও বাস্তবের ঈদের চেয়ে স্মৃতির ঈদ অনেক বেশি আনন্দঘন। তখন ভালো খাবারের জন্য, ভালো পোশাকের জন্য, ঈদের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হতো। ঈদের দিনকে মনে হতো মুক্ত ও স্বাধীন দিবস। আর এখন সব সুলভ। রোমাঞ্চ ফিকে হয়ে গেছে। চমক আর নাটকীয়তা নেই। খাবার, পোশাক এতো সহজ্যলভ্য যে, আলাদা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া ভার। অবশ্য যারা কঠোর তপস্যার মাধ্যমে রমজানের রোজা, তারাবির নামাজ ও অন্যান্য কর্তব্য পালন করেন, সেসব নিষ্ঠাবানের জন্য ঈদ জাগতিক উৎসবের চেয়ে আধ্যাত্মিক মাধুর্য্যই বেশি নিয়ে আসে। সেটা অবশ্য ধর্মতত্ত্বের অন্যতর আলোচনার বিষয়।
সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা ঈদ বা অন্য যে কোনো উৎসবে দেশজ সংস্কৃতির বিকাশই কামনা করবো। খাবারে, পোশাকে, আচরণে প্রকৃত স্বদেশি ও স্বধর্মীয় একটি আবহই প্রত্যাশা করবো। সমাজের মধ্যে, পরিবারের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের বন্ধনকেই দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকেই অনুভব করবো। উৎসব ব্যক্তিগত আনন্দের চেয়ে বরং ধর্মীয় চেতনা জাগানোর এবং সামাজিক উপভোগেরই বিষয়, এ বাস্তবতাটিই সামনে রাখবো। যার ফলে বিভিন্ন শ্রেণি ও দূরত্বের আত্মীয়-পরিজন যেন আপ্লূত হতে পারেন, সমাজের দরিদ্র ও অবহেলিত শ্রেণিও যেন আনন্দের ভাগ পায়, সেটাই লক্ষ্য রাখার দিকে গুরুত্বারোপ করবো।
বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক বেনোজলের উদভ্রান্ত স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ায় মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। কোনো দাম নেই অজানা, অচেনা বহুমূল্যের পোশাকে সঙ সেজে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও। বরং তৃপ্তি ও মর্যাদা রয়েছে মানুষের অন্তর ও আত্মাকে স্পর্শ করার মধ্যেই। মানুষের সুখে-দুখে সমব্যথী হওয়ার মধ্যেই রয়েছে মানবিক সাফল্য, ধর্মীয় বোধ, নৈতিকতার বিজয়। ঈদ ও অন্যান্য উৎসবের মানবিক, সামাজিক তাৎপর্যকে প্রাধান্য দিলে অর্থ ও বিত্তের উগ্র প্রতিযোগিতা কিংবা বিদেশের মুর্খ অনুকরণপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। মানুষে মানুষে মৈত্রী ও সৌহার্দ্য স্থাপিত হবে। সামাজিক বিন্যাস দৃঢ় হবে এবং মানুষ ও সমাজের নৈতিক মান উচ্চতর হবে। ধর্ম তেমনই আহ্বান জানায়। সংস্কৃতিও সেটাই বলে। নৈতিকতাও তেমনি দাবি করে। এই মূলস্রোতে ও চেতনার বাইরে গিয়ে পবিত্র ও সার্বজনীন উৎসবকে হট্টগোল ও আত্মগরিমা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিণত করা কেবল নিন্দনীয়ই নয়; অপরাধও বটে। নৈতিক দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য। উৎসবের সময় এ কথাগুলো মনে রাখা দরকার।
এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, উৎসব আমার একার নয়, আমাদের সকলেরই। ফলে উৎসবের আয়োজনের সময় আমার বল্গাহীন উপভোগ ও আনন্দ যেন বঞ্চিতের যাতনা আরও বাড়িয়ে না দেয়। দরিদ্র আত্মীয় ও সমাজের নিঃস্ব মানুষকে আরও বঞ্চিত করার ক্ষেত্র বা তৎপরতা যদি উৎসবে ঘটে, তবে সেটা হবে চরম দুঃখজনক। অতএব উৎসবের সময় মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক দিকগুলোকে কোনোভাবেই লঙ্ঘন করা যাবে না। আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বের দ্বারা উৎসব আয়োজনের এমন সমন্বয় করতে হবে, যাতে ঐক্য, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি পায়; ক্ষুণ্ন না হয়। উৎসবের শেষে যেন ধনী-দরিদ্র সবাই তৃপ্তি ও সন্তোষের আবহ উপভোগ করতে পারে। কারো হৃদয় যেন ক্ষত না হয়; কারো দুঃখ যেন আরো ভারী না হয়; কারো বঞ্চনা যেন আরো তীব্র না হয়।
দুই ঈদেই পত্রিকায় লাখ লাখ টাকার পোশাক এবং গরু কেনার ছবি ছাপা হয়। সঙ্গে থাকে ক্রেতার ছবিটিও। সেটা যে ইতিবাচক নয়, বুঝতে হবে। পোশাকের দামে বা পশুর ওজনে মানুষের দাম বা ওজন বাড়ে না, এটা জানলে লাখ টাকার লেহেঙ্গা গায়ে উল্লসিত তরুণীটি কিংবা নাদুস গরুর পাশের সুখী ক্রেতাটি লজ্জায় মুখ লুকাতো। মানুষ যে তাদেরকে পশুর সঙ্গে তুলনা করে হাস্যরস ও করুণা করছে, এটা সংশ্লিষ্টরা টাকার গরমে টের পান না। কিন্তু যদি তাদের বিবেক বলে সামান্য কিছু থাকে, তাহলে তারা সতর্ক হতেন। নৈতিক অবস্থান থেকে নিজের মানবিক মর্যাদা বিকাশে সচেষ্ট হতেন; সমাজের অপরাপর মানুষের মানবিক সম্মান ও প্রাপ্য প্রদানের মাধ্যমেই তারা সেটা করতেন। অতএব, অনুষ্ঠানে-উৎসবে সংস্কৃতির শুদ্ধতর প্রকাশ এবং মানবিক-সামাজিক-নৈতিকবোধের আলোকিত উদ্ভাসনই কাম্য। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-সাহিত্যিক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৭
জেডএম/