এই ভবনেরই দোতলার উত্তর-পশ্চিম কোণার একটি বা দুটি কক্ষ ছাত্রদের হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এরকম একটি কক্ষে ভাইয়া থাকতেন।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে না উঠতেই একটি গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনলাম-‘কে, কেন এখানে?’
নেমে যাব ভাবছিলাম। ওইসময় দেখলাম-এক ভদ্রলোক হাতে রাখা বই কিংবা পত্রিকা থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঈষৎ কোঁকড়ানো চল। খুব পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ইজি চেয়ার কিনা মনে পড়ছে না, তবে যে চেয়ারে বসা ছিলেন সেটা কিছুটা পেছনে হেলানো এবং নিচু ছিল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এদিকে আস। ’
সেজ ভাই চোখের ইশারায় যেতে বললেন। ভীতস্বরে চাপা গলায় বললেন, ‘ন গেইলে আঁরে উদ্দা মারিব। ’ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই ভদ্রলোক আবারও পরিচয় ও আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বড় ভাইয়ের নাম উল্লেখ করে আসার কারণ বললাম। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। ওইসময়ে মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষক মানেই অন্যরকম ব্যাপার ছিল।
তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, সততা ও সাহস ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে সমাজ ও ছাত্রদের জন্য আদর্শ বলে ধরা হতো। আমাদের অভিভাবকরা অন্তত তাই মনে করতেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এরকম সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয় না।
যাই হোক আমি ভাবছিলাম-মুসলিম হাই স্কুলের একজন শিক্ষকের সামনে কী ভুল করেছি আল্লাহ মালুম! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম-ভদ্রলোক ঠোঁট চেপে হাসি লুকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু চেহারায় রাগ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাও-তো অনুমান। আমার হাতদুটি ভদ্রলোকের মুঠোয়। এরপর তিনি জোরে হেসে ফেললেন। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। এরপর ভদ্রলোক কাকে যেন ডাকলেন। পাশের একটি কক্ষ থেকে এক ভদ্রমহিলা বের হলেন। আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। চিবুক ছুঁয়ে আদর করে দিলেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘শুকনো আদর করলে হবে?’ ওনার কথার জবাব না দিয়ে ভদ্রমহিলা ভিতরে চলে গেলেন।
ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘ভবিষ্যতে এই স্কুলে পড়বে কিনা বল, যদি ‘না’ বল মোস্তাফিজের কাছে যেতে দিব না। আমি না বুঝেই ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। এর মধ্যে ভদ্রমহিলা বিস্কুট এবং অনেকরকম নাস্তা নিয়ে ফিরলেন। এসেই নাস্তাগুলোর কিছু আমার হাতে দিলেন। আর গুলো সমানে আমার শার্ট প্যান্টের পকেটে ঢুকাতে লাগলেন। আমি বিস্ময়কর ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। ওনার রাগ, ওনার হাসি আর এতগুলো নাস্তা একসাথে!
শেষে বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, ‘যাও, মোস্তাফিজের কাছে যাও। কিন্তু খবরদার! বেশিক্ষণ থাকবে না। ওর ডিস্টার্ব হবে। পরীক্ষা খুব নিকটে। ’ সেজ ভাই তখনো স্যারের নাম জানতেন না। এমনি স্যার হিসেবে চিনতেন।
আমরা মোস্তাফিজ ভাইয়ের রুমে গেলে উনি বললেন, ‘এদিগ্গিন নাস্তা খালাম্মা দিয়েদে নে?’ আমি কিছু বললাম না। সেজ ভাই প্রশ্ন করলেন, ‘আইচ্ছা বদ্দা, স্যার ইবার নাম কি?’ ভাইয়া বললেন, ‘গর্দভ! মুসলিম হাইত পড়ছ্। এহনো কাশেম স্যারর নাম ন জানছ্!’ আমাদের ছোটদের মধ্যে কোন অজ্ঞতা বা ভুল চোখে পড়লে বড়ভাই আমাদেরকে প্রায়শ স্নেহভরে গর্দভ ডেকে সতর্ক করতেন বা শুধরে দিতেন।
যাই হোক ওইদিন বড় ভাইয়ার কথা শুনে বুঝে নিলাম-ওই ভদ্রলোকই কাশেম স্যার, আর ওনার নাম না জানাটা রীতিমত গাধামির শামিল। সেই প্রথমদিন থেকেই স্যারের নাম হৃদয়ের গভীরতম স্থানে গ্রোথিত হয়ে আছে। এই ঘটনা খুব সম্ভবত স্যারের বিয়ের পরপর। ফারুক-খালেদ এদের কেউই তখনো স্যারের জীবনে আসেনি।
আমাদের প্রাণপ্রিয় কাশেম স্যার না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ভীষণ মন খারাপ। আমি পিরোজপুর। তাই জানাজাতে যেতে পারিনি। নতুন বাসাটা চিনি না বলে ছোট ভাই ইব্রাহিম ও বন্ধু শাহাদাতের সাথে স্যারের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। হল না। নিজের উপর রাগ লাগছে। স্যার এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব।
ক্লাস নাইনে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক এবং বার্ষিক পরীক্ষার আগে এক এক করে সর্বমোট তিনদিন স্যারের কাছে হিসাবরক্ষণ প্রাইভেট পড়েছিলাম। ওইসময় আমাকে বললেন, ‘তিন পরীক্ষার আগে তোরে তিনদিন নিজে ডেকেই পড়িয়ে দিলাম। এর বেশি আর তোকে পড়াতে হবে না। আশা করি অন্য কোন স্যারের কাছেও আর পড়তে যেতে হবে না। ’ স্যার আরও বলেন, ‘তোরে দিনের পর দিন আসতে বলে টাকা নিতে পারতাম। তিনদিনের পড়া তিনমাস কেন, তিনবছরও পড়ানো যায়। অনেক টাকাও নেওয়া যায়। কিন্তু আমার ওই টাকার দরকার নাই। ’ যেহেতু কোর্স শেষ করে দিয়েছিলেন, দুই-এক দিন পড়লেও, আব্বা স্যারের জন্য বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যারকে গ্রহণ করাতে পারিনি। এতটা নির্লোভ ছিলেন স্যার।
আজ আর স্যার নেই। কত কথা মনে পড়ছে! হৃদয় কাঁদছে। তবারক, মনির, তানভীর, ফরহাদ, মোশারফ, ইমন, মিডু, মহিউদ্দীন, মিতুল, জাহেদ, কাদেরসহ আমার সমস্ত বন্ধুরা কাঁদছে। কেউ কেউ বারবার ফোন করছে। মেসেজ দিচ্ছে। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত মুসলিম হাই স্কুলের সমস্ত ছাত্র আজ আরও একজন অভিভাবককে হারালো। আজ আকাশও যেন শোকাহত। এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে স্যারের জন্য বেদনাহত হৃদয়গুলোর ন্যায়। চাটগাঁর অবিশ্রান্ত বর্ষা যেন ক্রন্দনরত হৃদয়েরই প্রতিচ্ছবি।
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান: বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ) ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, পিরোজপুর।