সে সময় প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবীদের মাথায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি আসে। যেমন গ্রামে বসবাসকারী অধিকাংশ জনগণ ন্যূনতম আধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এবং যুদ্ধই হোক বা শান্তিসময়কালীনই হোক- নারীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া একটি দেশের কোনরকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।
যেমন উপলব্ধি তেমন কর্ম, ঢাকার অদূরে সাভারের বাইশমাইল এলাকায় তাবু ফেলে গ্রামের মানুষের ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা আর অর্থনেতিক উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে পথ চলতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠানটি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে আত্বপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা উদ্যোগী হয়ে গ্রামে গিয়ে, গ্রামে বসবাস করে, গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচি নির্বাচন করে এগিয়ে যায়। খুব ভোরে প্রতিষ্ঠানটির ঘুম ভাঙ্গে। সবার দিন শুরু হয় ভোর ছ’টায় ভোরের কৃষিকাজ দিয়ে, এর পরই অন্যান্য দায়িত্বে তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা বিলেত ফেরত ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেও সবার মতই কাস্তে নিয়ে কৃষিকাজ করছেন। বিষয়টি তখন আলোচনার বিষয় ছিলো, আজ এটি অনুভবের। কারণ কৃষি হারিয়ে যাচ্ছে, কৃষি বিমুখ হচ্ছে মানুষ। তারই মোহনীয় নেতৃত্বের গুণে অনেক ভক্তরা দীর্ঘদিন একসাথে একই উদ্দেশ্যে কাজ করাতে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ এনজিও থেকে শান্তি নিকেতন হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠানটির সংস্কৃতির সাথে মিশে যায় এখানকার মানুষগুলো। দায়িত্ব নিয়ে চেয়ারে বসে দম নেয় না, আয়নায় চেহারা দেখে না এমন সব মানুষের মিলনমেলা হয়ে যায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
সম্ভবত গণস্বাস্থ্য আমাদের সমাজকে সবচেয়ে ভালো জানে। এজন্যই ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক শ্রেণি এবং আয়ের উপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্যবিমা চালু করে। এখানে ধনীরা বেশি প্রিমিয়াম এবং দরিদ্ররা কম প্রিমিয়াম প্রদান করলেও সকলেই একই স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকেন। শুধু গ্রামের প্রয়োজনে নয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শহরের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনেও এগিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠিত করেছে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা শহরের দরিদ্র পরিবারের জন্য বার্ষিক মাত্র ৩০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সাধারণ মানুষের আজন্ম ভালো লাগার একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির কথা ভাবলে আমার সামনে অনেক ভালো লাগার দৃশ্যপট ভেসে উঠে। একদিন আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য কেন্দ্র অতিক্রম করে মেডিসিন বহির্বিভাগের দিকে যাচ্ছিলাম, একজন প্রবীণ মহিলা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যবিমা হাতে কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইছে আমার বউমার বাচ্চা প্রসবের জন্য কত টাকা খরচ হবে? দায়িত্বপ্রাপ্ত এক গণস্বাস্থ্য কর্মী তার হাতে থাকা স্বাস্থ্যবিমাটায় চোখ বুলাতে-বুলাতে বললেন- খরচ সত্তর হাজার টাকা হলেও আপনি দেবেন মাত্র এক হাজার। এক হাজার দিতে পারবেন তো ? গ্রাম্য অতিসাধারণ বৃদ্ধা মহিলা স্বস্তি সহকারে বললেন- পারবো। মূল সত্য আরো অবিশ্বাস্য। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অনেক হত দরিদ্রদের একেবারে বিনে খরচায় ডেলিভারি করে থাকে। অতি সাধারণের সন্তান প্রসবের বিষয়টি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র বিন্দুতে সব সময় সজাগ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অসাধারণ কর্মচঞ্চল একজন অতি সাধারণ মানুষ যিনি কাজের আনন্দে সাধারণের মাঝে হারিয়ে যেতেন। তিনি খোলা মাঠে ঘাসের মধ্যে বসে গ্রামের দাইদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন- কীভাবে নিরাপদে বাচ্চার জন্ম দেয়া যেতে পারে। নাম মাত্র মূল্যে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েও দীর্ঘ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে, আর সেই আয় দিয়েই প্রতিষ্ঠানটির কাছাকাছি অতি মনোরম নিসর্গে নির্মিত হয়েছে এদেশের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, গণবিশ্ববিদ্যালয়। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্ম হয়েছিলো সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে। গণবিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করেছে সমাজের প্রয়োজনে। কেননা এর পড়ানোর বিষয় দেখে মনে হয় এটি শুধু বুদ্ধিজীবী তৈরী করবে না, তাকে সমাজের প্রয়োজনে আরো বেশি সংশ্লিষ্ট রাখবে। আজন্ম জনসম্পৃক্ত গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র পয়তাল্লিশ বছর পার করে এসেছে। শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা প্রতিষ্ঠানটির জন্য। স্বার্থক এবং মহিমান্বিত হোক এর সকল কর্মকাণ্ড।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৭
আরআই