কদিন আগেই লিখেছিলাম, কানাগলি থেকে রাজপথে জামায়াত। সপ্তাহ পেরুতে না পেরুতে শুধু রাজপথে ওঠাই নয়, সেখানে রীতিমতো তাণ্ডব চালালো জামায়াত।
আমি ঐ কলামে লিখেছিলাম, জামায়াত তৈরি হয়ে আছে বিএনপির গায়ে কাদা লাগাতে। ঠিক তাই হয়েছে। সাদা চোখে জামায়াতের হিংস্রতাই শুধু চোখে পড়বে। ক’দিন পরেই জামায়াত নেতারা বিএনপির সাথে একই মঞ্চে উঠে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে যাচ্ছে। ঠিক তার আগেই জামায়াত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদের মুক্তির দাবিতে পরিকল্পিতভাবে ১৯ সেপ্টেম্বর মোটামুটি সারা দেশে যে তাণ্ডব চালালো সেটা নেহায়েত আচমকা কোনও ঘটনা নয়। এরপরে যখন জামায়াত-বিএনপি এক সঙ্গে মঞ্চে উঠবে এবং কৌশলে যুদ্ধপরাধীদের মুক্তির বিষয়টা টেনে আনবে তখন বিএনপি কোনও প্রকারেই জামায়াতি দুর্গন্ধ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। মূলত ১৯ তারিখের বিক্ষোভ এবং তাণ্ডব ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং এর মাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলনের সাথে যুদ্ধপরাধীদের মুক্তির বিষয়টা সুকৌশলে যুক্ত করলো জামায়াত।
আমি লিখেছিলাম, আওয়ামী লীগও চাইবে বিএনপিকে জামায়াত ঘেঁষা করতে। এই দুই শক্তির কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে বিএনপি ধীরে ধীরে ক্রিমিনালাইজেশনের পথে ধাবিত হচ্ছে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়েও দেখতে পাচ্ছি, নেতৃত্বের দূরদর্শীতার অভাবে ধীরে ধীরে কিভাবে বিএনপি গভীর সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে।
আমার মতে, উভয় সঙ্কটে পড়েছে এখন প্রধান বিরোধী দল। বিএনপি যদি জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে তবে নিজ দলের অনেকেই তার সংগে যুক্ত হবে বলে মনে হয় না। অনেক ছোট ছোট শরিক দলও না আসতে পারে। জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে গেলে নতুন প্রজন্ম, যারা সিংহভাগ ভোটার মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। আর কোনওভাবে বিএনপি ভোটে জিতে আসলেও এবার জামায়াত ২০০১ এর মতো ভুল করবে না। তারা ক্ষমতার নিরঙ্কুশ ভাগ নিয়ে ধীরে ধীরে বিএনপিকে গিলে খাবে। আমি দিব্যি করে বলতে পারি আওয়ামী লীগ যুদ্ধপরাধীদের বিচার তাদের এই শাসন আমলে পূর্ণতা দেবে না। একটা পর্যায় নিয়ে প্রক্রিয়ার গতিকে থামিয়ে দেবে এবং অপেক্ষা করবে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত। ক্ষমতায় আসলে তো ভাল। না হয় বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলেও পোয়া বার। মৃত্যুকূপের সামনে দাঁড়ানো যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতাদের নিয়ে কেমন ফ্যাসাদে পড়ে বিএনপি সেটা তারা দেখবে আর হাসবে। বিএনপির জন্য বিষয়টা না ঘরকা না ঘটকা হয়ে দাঁড়াবে। জামায়াতের চাপে অপরাধীদের ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ ব্যাপক জন সমর্থন নিয়ে আগাম আন্দোলনে যেতে পারবে।
জামায়াত চাইছে নিজের কানটা তো কেটেছে, এখন বিএনপিকে সাথে নিয়ে তার কানটাও কাটতে। অথবা বিএনপির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে কাটা কান জোড়া লাগাতে। দুটোর কোনটাতেই বিএনপির স্বার্থ জড়িত নেই।
জামায়াতের উপর লেখাটার পরে বেশ কিছু মেইল পেয়েছি। তার কিছু ছিল ভদ্রভাবে বোঝানোর চেষ্টা এবং কিছু ছিল কুৎসিত মন্তব্যে ঠাসা। আমি খুবই সামান্য একজন ব্যক্তি। মানুষ হিসেবে আমার কোনও প্রভাবই সমাজে নেই। তারপরেও সামান্য লোকের সামান্য লেখায় পাঠক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে জিঘাংসাই ফুটে উঠেছে মাত্র। এদের কারো কারো বয়স খুবই কম। এদের কিভাবে শিবির রিক্রুট করলো তা গভীর ভাবনার বিষয়।
একজন জানতে চেয়েছে আমি মুসলমান কিনা। এই সব ধর্মান্ধের কাছে জানতে চাই, নারী পুরুষ ভর্তি চলন্ত গাড়ি ভাঙচুর করে তাতে আগুন দেওয়া ইসলামের কোথায় আছে? ইসলামের কোথায় আছে যে আইন বহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করা? ইসলামের কোথায় লেখা আছে মানুষ হত্যা করে তার মুখে পেচ্ছাব করে দাও?
জামায়াতের মতো শ্বাপদেরা এভাবেই অনেক কিছুর মতোই পবিত্র ধর্ম ইসলামকেও ক্রিমিনালাইজড করছে। তারা ইসলাম এবং জামাতকে পরিপূরক দেখিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সহানুভূতি পাবার চেষ্টায় আছে। এরাই ইসলামের বড় শত্রু। এদেরকে রুখতে হবে।
মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সেই ১৯৯৪/৯৫ সাল। মাত্র কয়েক বছর আগে শিবিরের হাতে ছাত্রদলের নেতা কবির নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এইচএসবি হলের সিঁড়ির নিচে কবীরকে হত্যার সময় শিবিরের পাষণ্ডরা হাতে তালি দিচ্ছিল যাতে তার চিৎকারের শব্দ কেউ শুনতে না পায়। এরপর থেকে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ব্যানারে শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয় ক্যাম্পাসে। নিষিদ্ধ হলেও তারা তলে তলে নিজেদের সংঘটিত করতে থাকে। হঠাৎ সকালে প্রাক্তন রুমমেটের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে বলছিল “মিঠু বের হ। শিবির ক্যাম্পাস দখল করে নিয়েছে। কাকে যেন দেখলাম কামালউদ্দিন হলের দোতলা থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে”।
তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে সবাইকে ঐ কাক ডাকা ভোরে জাগিয়ে মুক্তাঞ্চলের দিকে (এমএইচ হল তখনো দখল হয়নি) রওয়ানা হলাম। কাউকে সংঘটিত করতে হয়নি। কি অসাধারণ স্বতঃস্ফুর্ততায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্বে এসে শিবিরকে প্রতিহত করলো। কি অপূর্ব মিল খুঁজে পেলাম কোন্দলরত বিভিন্ন দলের মধ্যে শিবিরকে বিতাড়িত করার জন্য। বিস্ময়ের চোখে দেখলাম পাশের রুমের সেই তথাকথিত ‘নিরীহ’ ছাত্র আসলে যে শিবিরের ক্যাডার ছিল অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে।
ক্যাম্পাসে যে ত্রিভুজ গন্তব্যে (হল, ডাইনিং এবং ক্লাশ রুম) সীমাবদ্ধ ছিল, সেই আপাত নিরীহ ছেলেটা যে গোপনে বহুবার চট্টগ্রামের পাহাড় ডিঙিয়েছে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য সেটা ঘুণাক্ষরেও কেউ বোঝেনি। যেমন পুলিশ বোঝেনি কি ঘটতে যাচ্ছিল গত ১৯ তারিখে।
পুলিশের গোয়েন্দাদের পর্যন্ত বোকা বানিয়ে কৌশলে কি তাণ্ডবই না চালালো। এভাবেই সন্তর্পণে শিবির তার ক্যাডার বাহিনীকে গোপনে সংঘটিত করেছিল সেদিন জাবি ক্যাম্পসে। ব্যথিত হয়ে দেখলাম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন কী নির্লজ্জভাবে শিবিরের হাতে ক্যাম্পাসটাকে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে আমরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রথমে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পুলিশ দিয়ে ওদের সরাতে পারবো। কারণ প্রচুর বহিরাগত ক্যাডার এসেছিল ওদের সংগে। কিন্তু বারবার পুলিশ চেয়েও আমরা পাইনি। পুলিশ এসেছিল; কিন্তু সেটা ওদের বাঁচাতে। সবাই যখন ওদের ঘিরে ফেলেছিল, তখন মন্ত্রী মতিন পুলিশ পাঠিয়ে ওদের রক্ষা করেছিলেন।
শুটকি মাছ নিয়ে যেমন বাসে ভ্রমণ করা যায় না। সব যাত্রীর আপত্তি থাকে তার উৎকট গন্ধে। জামায়াতের গায়ে যুদ্ধপরাধের গন্ধ লেগে আছে, রগ কাটার ইতিহাস জড়িত আছে তাই রাজনীতিতেও জামায়াতের স্থান থাকার সুযোগ নেই।
নিচের উপকথার বাঘের চরিত্রের মতোই পবিত্র জামায়াতের চরিত্র। একবার এক বাঘ কাদার ডোবায় আটকে মরতে বসেছিল। সেই মুহুর্তে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পথচারীকে অনুনয় বিনয় করে তাকে বাঁচাতে বলে। পথচারী শেষমেষ রাজি হয়ে তাকে মত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে। বিপদ কেটে যাবার পরে বাঘ ঐ পথচারীকেই প্রথম খেতে উদ্যত হয়। এক শিয়াল ঐ পথ দিয়ে যাবার সময় ঘটনা দেখে বুদ্ধির জোরে তাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। শিয়াল সব সময় ধূর্ততার প্রতীক হলেও এখানে তার ভূমিকা ছিল বুদ্ধিমান বন্ধু হিসেবে। ঐ পথচারীর আগে কখনো বাঘের শঠতার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই সে বোকামীর দণ্ড দিতে মরতে বসেছিল। কিন্তু বিএনপির জামাতের বিশ্বাসঘাতকতার বহু বহু অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই সব বেঈমান, মোনাফেক, স্বাধীনতাবিরোধীদের ‘বিপদ চক্র’ কেটে গেলে পা থেকে তাদের হাত তুলে এনে সোজা ঘাড়ে ধরে বসে। ভাই এর বদলে ‘শালা’ ডাকতে কসুর করে না। স্বাধীনতার পরপর সাধারণ ক্ষমা পেয়েও জামায়াত তাই করেছে। বিএনপির গায়ে পরগাছার মতো সেঁটে থেকে পরবর্তীতে সুসময়েও একই কাজ করেছে বারবার।
বাংলাদেশ সময় ১২৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১১