সকালবেলা মানুষের মন ও মেজাজ বেশ স্নিগ্ধ ও ফুরফুরে থাকে। তারপরও কিন্তু পত্রিকার নেতিবাচক খবরে মন স্থির রাখা প্রায়শ সম্ভব হয় না।
‘নতুন আইনে সাইবার অপরাধের ধরন ও শাস্তি সুস্পষ্ট থাকবে
আমার পরিচিত জনের সঙ্গে আমার ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী এবং তার আত্মীয়-স্বজনের বন্ধুত্ব আছে ফেসবুকে। আপত্তিকর ছবিটি তিনি লোড করেন নি; তাকে ট্যাগ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! এ তো সবাই দেখছে। তিনি খবর পেয়ে বা অপছন্দ করে ওই কুৎসিত ছবি ডিলিট বা মুছে না-ফেলা পর্যন্ত তো বিশ্বজুড়ে সবাই সেটা দেখবেই।
যারা সাবালক তাদের কথা আলাদা। কিন্তু ছোটরাও তো আজকাল ফেসবুকে আছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না কী করবো? এসব কথা কাউকে জিজ্ঞেসও করা যায় না। কোনও মন্তব্য লিখে প্রতিবাদ করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাহলে সবাই তো বুঝবে আমিও ছবিটি দেখছি এবং এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করে বিষয়টিকে উপভোগ করছি। আমার মতো অনেকেই বুঝেন যে, এ নোংরামি আসলে ভয়ানক বদমাইশি এবং নিম্নশ্রেণীর বিকৃতি।
একদিন চেনা একজন আশ্চর্য এক ঘটনা জানায়। যার ব্যাপারে জানাচ্ছে, ধরা যাক তার নাম ‘ক’। ‘ক’ ফেসবুকে কয়েকটি একাউন্ট করেছে নামে-বেনামে। ব্যাঙ্কে কালো টাকা রাখার জন্যে বেনামি একাউন্টের মতো ব্যাপার মনে হলো আমার আছে বিষয়টি। ‘ক’ তার ফেক-একাউন্টের মাধ্যমে উত্তেজক ছবি নিজের ওয়ালে পোস্ট করে; অন্যত্র এমন কুৎসিত কিছু পেলেও অশালীন মন্তব্য করে সেসবে যোগ দেয়। ‘ক’ একদিন দেখলো একটি মেয়ের ছবিতে বহুজন লাইক দিয়েছে। সে ছবিটিতে ক্লিক করে ফুলস্ক্রিনে দেখে চমকে গেল। এ যে ওরই ছোট বোন! বাসের ভিড়ে কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে হয়তো ওর ওড়নাটা সরে গিয়েছিল। আর কেউ একজন তখনি গোপন এঙ্গেল থেকে মোবাইলে লোভনীয় ভঙ্গিতে ছবিটি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে দিয়েছে। তখনই ‘ক’ টের পেল সে নিজে মানসিক বিকৃতিকে আক্রান্ত একজন মানুষ এবং এ কারণে সে-ও মানসিক বিকারগ্রস্থ একদল অচেনা নোংরা লোকের সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েছে, যারা তার বোনকে পর্যন্ত ছাড়ছে না।
‘ক’-এর বোধোদয় হলো তখনই, যখন সে নিজেই বোনের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে। যারা এমন কুৎসিত কাজে আক্রান্ত তারা হয়তো নিজেদের ঘরের মা-বোনদের কথা স্মরণ রাখে না; কিংবা মানুষ হয়েও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে খুব আদিম বা পশুর মতো জ্ঞান রাখে। এরা যখন মানুষের সমাজে মিশে তখন পশুর মতোই ‘কাজ’ বা ‘আচরণ’ করে। অতএব বাধ্য হয়ে অধিকাংশ সুস্থ মানুষ এমন আপত্তিকর ও অশ্লীল বিষয় ‘উপেক্ষা’ করে। উপেক্ষা করেও কিন্তু মনে শান্তি পাওয়া যায় না। কারণ, ছবিটা তো থেকেই গেল। একটি মেয়ে গোটা বিশ্বের সামনে লাঞ্ছিত হলো এবং কতিপয় বিকৃতমনা পশু-মানুষের খোরাকে পরিণত হলো। এর চেয়ে মানবিক বিপর্যয় ও অপমান আর কি হতে পারে!
সবই দেখলাম অথচ কিছুই না দেখার ভান করলাম; এক অর্থে এমন অবস্থা আমরা যারা নিতে বাধ্য হই, সেটাও এক অক্ষমতাই বটে। এখন মনে হচ্ছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের কোনও অপছন্দনীয় বিষয়/ছবিকে ‘উপেক্ষা’ করাটা আসলে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার নামান্তর হলেও এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষেধক।
এটা ঠিক যে, সাইবার জগতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে মানসিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেও কাজটি অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে এখানে যাচ্ছে-তাই ধরনের পরিস্থিতিও তো চলতে পারে না। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে ইনট্রোডাকশন লাগে। যেমন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলেও লাগে। তাহলে একটা আইডেনটিটি স্বীকৃত হল। আবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নানা ‘হ্যাঁ’-এ ক্লিক করে এগিয়ে এগিয়ে ফাইনালি ডিজিটাল জগতে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। অনেকেই কিসে ‘হ্যাঁ’ করেছেন, মনে রাখেন না। আর একাউন্ট খোলার সময় তো সবাই ‘সুনাগরিক’। এরপর ফ্রেন্ডশিপ অ্যাকসেপ্ট করলে তবেই অ্যাকসেসের অনুমতি পাওয়া যায়। এটাও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে চুক্তি বিশেষ। এখন যদি সব কিছু ‘উপেক্ষা’ করতে হয়, তাহলে এতোসব চুক্তি ও শর্তের কী প্রয়োজন? ওয়েবসাইটগুলো চুক্তি-শর্ত উঠিয়ে দিলেই পারে!
এ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ‘উপেক্ষা’ ও ‘পরিত্যাগ’ই শেষভরসা। রুচিহীনতা যে কোনও পর্যায়েই নামুক, ‘পরিত্যাগ’ ও ‘উপেক্ষা’ নামক গণতন্ত্রসহায়ক ভীষণ হাতিয়ার কিন্তু সব সময়ই আমরা প্রয়োগ করতে পারি। নিয়ন্ত্রণের ছড়ি ঘোরানোর চেয়ে অনেকাংশেই শক্তিশালী অথচ সহজতর এ ‘উপেক্ষা’র পথ। প্রয়োগ করতে পারলে মূলেই বিনষ্ট ও কোণঠাসা হবে হীনচেষ্টা।
তত্ত্বগতভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমা কতটা বা কোথায়, বাস্তবে থাকলেও সাইবার ভুবনে এর মাপকাঠি নির্ধারিত নেই। যা আছে তা হল একটি মানসিক সীমানা আর মূল্যবোধের আড়াল। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে রুচির তারতম্যে এই সীমানা ও আড়াল বাড়ে-কমে বটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও সামাজিক জীবনে ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমানা ও মূল্যবোধের আড়াল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় নয়; অন্যের জন্যেও হয় সুখের, নয় হানির কারণ। ফলে কারও কু-চেতনা যে অধিকাংশের সু-চেতনায় হানি ঘটাচ্ছে, এ কথাটা আঘাত নয়, ‘পরিত্যাগ’ ও ‘উপেক্ষা’ করে বার বার মনে করিয়ে দিয়ে এটাই জানান দিতে হয় যে, সমাজে তোমার উপযোগিতা নেই, তুমি পরিত্যাজ্য। ঘৃণা, পরিত্যাগ ও উপেক্ষার শক্তিই এখানে একমাত্র সম্বল। যেমন আমরা সমাজে ও রাজনীতিতে অনেক কিছু উপেক্ষা ও ঘৃণা করি, তেমনই আর কি!
উপেক্ষার সঙ্গে সতর্কতাও জরুরি। সাইবার ঝড়ে আপনি, আমি সকলেই কোনও না কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে বাধ্য। ফেসবুকের কথাই ধরি। প্রতিদিন দেখা হওয়া সম্ভব নয় সময়ের বা দূরত্বের কারণে, এমন বন্ধুদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। নিজের স্বচ্ছ অনুভূতি, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি খুব সহজে ও অতি দ্রুত তাদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় ফেসবুকের মাধ্যমে। হারিয়ে যাওয়া পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে, নতুন কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে, কাছের/দূরের বন্ধুদের সঙ্গে চিন্তার নৈকট্যে থেকে ফেসবুকের উদ্ভাবক মার্ক জুকারবার্গকে ধন্যবাদ দেয় না, এমন লোক সামান্যই। এখন তো এমনও বলতে শোনা যায়, যার ফেসবুক আইডি নেই, পৃথিবীতে তার কোনও অস্তিত্বই নেই।
ফলে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নতুন আইডি খুলে ফেসবুকের আবর্তে চলে আসছে। কিন্তু যারা কুরুচিপূর্ণ, বিকারগ্রস্ত, তারা রাস্তায় থাকুক অথবা ফেসবুকে, সবখানেই তাদের বিকৃত-রূপ একই রকম। এ কারণে ফেসবুকের পরিবেশও বিষাক্ত হচ্ছে। অশ্লীল নামের ভুয়া পেজে বা অশ্লীল ও আপত্তিকর বা সাধারণ্যে ব্যবহার অনুপোযোগী ছবিতে দুষিত হচ্ছে ফেসবুক এবং যারা সুস্থ, সামাজিক, মুক্তমনা ব্যবহারকারী তারাও। এ কারণে উপেক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীদের সতর্কও থাকতে হয়। কেউ আপনাকে আক্রান্ত করতে পারে কিংবা আপনাকে ব্যবহার করে অন্যকেও আক্রমণ করতে পারে। আপনার অগোচরে আপনার কোনো কিছু অশ্লীল বা বিকৃতভাবে অপ-প্রয়োগও করে ফেলতে পারে কোনও মানসিক-অপরাধী। ফলে আপনার ব্যক্তিগত ছবির অ্যালবাম, ভিডিও ইত্যাদিতে প্রাইভেসি সেটিং দিয়ে রাখুন। তাহলে আপনার বন্ধু তালিকার নিদির্ষ্ট ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছাড়া অন্যরা সেটা দেখতে পারবে না। যেটা পাবলিবলি দেখাতে চান সেটার কথা অবশ্য আলাদা। অচেনা কাউকে বন্ধু করার আগে দশ বার ভাবুন। আইডিটি আসল না ফেক সেটা যাচাইয়ের চেষ্টা করুন।
মাঝে মাঝে অচেনা বন্ধুর ওয়ালে গিয়ে তার এক্টিভিটি ফলো করে দেখুন, আসলে সে কি নিয়ে ব্যস্ত আছে। যদি ওকে দেখা যায়, বিকৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তবে তাকে নির্দ্বিধায় বন্ধু তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলুন। আপনি কোন পোস্ট আপনার কোন বন্ধুকে দেখাতে চান, অথবা দেখাতে চান না, সেগুলোও প্রাইভেসি সেটিং-এর মাধ্যমে নির্ধারিত করুন। মনে রাখা ভালো, ফেসবুকের মতো একটি খোলা জানালার ‘দেয়াল’ উন্মুক্ত থাকুন আপনার ও আপনার পছন্দের বা সুস্থ মনের মানুষের অনুভূতি বা ছবি শেয়ার করার জন্যে; নিজেকে বা অপরকে কলুষিত করার জন্যে নয়।
এসব কথা বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হবে এজন্য যে, দেশের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীরা প্রবলভাবে ফেসবুকে আসক্ত হচ্ছে। ক্লাস ও পড়া ফেলে আপনার বা আমার সন্তানও যে ফেসবুকে মেতে নেই, সেটা কে জানে! তার সঙ্গে নেটওয়ার্কে সংশ্লিষ্ট থেকে লক্ষ্য রাখুন, সে কার বা কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। তার ফেসবুক ব্যবহারের মাত্রা এবং পরিধিটিও সীমানা ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছে কিনা, ঠাণ্ডা মাথায় সেসবও খেয়াল রাখা দরকার।
প্রতাপশালী তথ্যপ্রযুক্তির গতিবেগকে অস্বীকার করা বা আটকানোর কোনও সুযোগ নেই, এটা সত্য। এটাও সত্য যে তথ্যপ্রযুক্তি মানে কেবল ফেসবুক নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের অবারিত সুযোগও তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কাজে লাগানো দরকার। দরকার ভালোর পেছন পেছন চলে আসা খারাপকে আটকানো বা বর্জন করা। ব্যক্তির চূড়ান্ত সতর্কতাই এক্ষেত্রে আপাতত একমাত্র প্রতিষেধক।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৭
জেডএম/