ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতির চিরায়ত মূল্যবোধ ও আদর্শ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
রাজনীতির চিরায়ত মূল্যবোধ ও আদর্শ

প্রচলিত রাজনীতির কিছু পরীক্ষিত মূল্যবোধ ও আদর্শ রয়েছে। কাল-কালান্তরে, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে, ইতিহাসের পর্বে পর্বে এসব চিরায়ত মূল্যবোধ ও আদর্শ নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। অতীত থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মানুষের কাছে এসব মূল্যবোধ ও আদর্শ গৃহীত হয়েছে। রাজনীতি কখনোই এইসব পরীক্ষিত ও সর্বজন গ্রাহ্য মূল্যবোধ ও আদর্শের বাইরে যেতে পারে না। গেলে সেই রাজনীতি মূল্যবোধ ও আদর্শ শূন্য বলে বিবেচিত হয়। সেই রাজনীতি মূল্যবোধ ও আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়েছে বলে চিহ্নিত হয়।

ইতিহাসের গভীর থেকে আহরিত উদাহরণের মাধ্যমে রাজনীতির মূল্যবোধ ও আদর্শের বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সহজ ভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। এ তথ্য অনেকেরই জানা যে, সুপ্রাচীন আমলে ভারতবর্ষে রাজা বিন্দুসার নামক একজন রাজা ছিলেন।

রাজা বিন্দুসারের রাজত্বে এক শ্মশানচারী ব্রাহ্মণের নাম ছিল দ্বৈপায়ন ঠাকুর, যিনি ছিলেন নির্লোভ, অবৈষয়িক ও সাধক।

শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে শবদেহের সঙ্গে বয়ে আনা মৃতের ভালোবাসার দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে সেই বস্তুটি খুঁজে বেড়াতেন দ্বৈপায়ন ঠাকুর, যা আপন হৃদয়ে ঢেউ তোলে। খুঁজতে খুঁজতে দ্বৈপায়নের সংগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

শ্মশানচারী ব্রাহ্মণ দ্বৈপায়ন ঠাকুরের সংগৃহিত প্রধান দ্রষ্টব্যের মধ্যে অন্যতম হলো তিনটি বস্তু: একটি গোবৎস, এক গৃহস্থের লক্ষ্মীর ঝাঁপি আর সুভদ্রাঙ্গি নামের এক কন্যাসন্তান। নিরাপত্তার জন্য ব্রাহ্মণ রাজা বিন্দুসারের কাছে তাঁর প্রিয় বস্তু তিনটি গচ্ছিল রাখেন। ব্রাহ্মণ ‘বিশ্বাস’ করেন রাজাকে। এবং আশা করেন যে, রাজা দ্রব্যগুলোর ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করবেন। ব্রাহ্মণ ‘বিশ্বাস’ ও ‘নিরাপত্তা’ নামক দু’টি মূল্যবোধ রাজার কাছে আশা করে ছিলেন। তিনি আরও মনে করেছিলেন যে, একমাত্র রাজারই ‘আদর্শ’ হলো এসব ‘মূল্যবোধ’ সংরক্ষণ করা।

কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজা চরম বিশ্বাসহীনতার পরিচয় দেন। তিনি ‘বিশ্বাস’ ও ‘নিরাপত্তা’ নামক মূল্যবোধের পাশাপাশি ‘দায়িত্ববোধ’ নামের মূল্যবোধটিও দেখাতে পারেন নি। রাজার মধ্যে চরম ‘আদর্শহীনতা’ পরিলক্ষিত হয়। ‘মূল্যবোধ’ ও ‘আদর্শ’ ধারণে তিনি ব্যর্থ হন।

কাহিনীর বর্ণনা মতে, রাজা বিন্দুসার দ্বৈপায়ন ঠাকুরের গোবৎসটিকে বলি দিয়ে খান, লক্ষ্মীর ঝাঁপিটিকে আবর্জনার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেন এবং কালক্রমে তাঁর সেই কন্যা সুভদ্রাঙ্গিকে পৈচাশিকভাবে ভোগ করেন। কাহিনী এখানেই শেষ নয়। বরং শুরু। ‘মূল্যবোধ’ ও ‘আদর্শ’ বিসর্জন দেওয়ায় রাজা ও রাজনীতির কি পরিণতি হয়েছিল, সেটাই কাহিনীর আসল কথা।

রাজার এমন ভয়ানক দুরাচারের সময়ে বিন্দুসার-পুত্র অশোকের জন্ম হয়। পিতার অন্যায়ের কলঙ্কিত দুঃশাসনকে যুদ্ধ আর রক্তের সাগর পেরিয়ে অশোক রক্ত-পিপাসুতে পরিগণিত হন। কলিঙ্গের যুগে যে পরিমাণ রক্তপাত ও প্রাণহানি হয়েছিল, সেটা এখন পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসের একটি কলংকিত অধ্যায়। ব্যক্তিগতভাবে সম্রাট অশোক সেই যুদ্ধে কিরূপ বেদনা ও কষ্টভোগ করেছিলেন, তা শাহরুখ খান ও কারিনা কাপুর অভিনীত ‘অশোকা’ নামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন, তারা বিলক্ষণ অনুভব করেছেন। অবশ্য রণাঙ্গনের রক্ত পেরিয়ে অশোক শেষ পর্যন্ত শান্তিবাদীতে রূপান্তরিত হন এবং জনগণের ‘বিশ্বাস’ অর্জন করে ভারতবর্ষে ‘নিরাপত্তা’ নামক মূল্যবোধটি নিশ্চিত করেন এবং ‘শান্তি’ নামক ‘আদর্শ’টি প্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বর্ণিত উপরোক্ত কাহিনী থেকে এই উপসংহারে পৌঁছায় যে, রাজারা কেবল সৃষ্টি করে সবকিছু বিনষ্ট করলেই বিজয়ী হতে পারেন না। মানুষের রক্ষণ আর নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমেই রাজার পক্ষে জয়ী এবং ইতিহাসখ্যাত হওয়া সম্ভব হয়। রাজাকে সফল হতে হলে কিছু মূল্যবোধ ও আদর্শ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই প্রতিপালন করতে হয়।

রাজা বিন্দুসার ও অশোকের সহস্র বছর পরের পৃথিবীতে রাজাদের দিন আর নেই; এখন চলছে রাজনীতিবিদ আর নেতাদের আমল। কিন্তু রাজ্যশাসন ও রাজনীতিতে প্রাচীন আমল থেকে প্রতিষ্ঠিত ও পরীক্ষিত মূল্যবোধ ও আদর্শগুলোর মতো চিরায়ত বিষয়গুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। আস্থা, বিশ্বাস, প্রজাহিত, নাগরিক শান্তি ও নিরাপত্তা, কল্যাণ, সুশাসন এখনো রাজ্য-রাজা-রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। শুভবোধ, সৌন্দর্যবোধ, সত্যোপলব্ধির মতো মূল্যবোধ ও আদর্শের হাত ধরেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন প্রসিদ্ধ শাসকরা।

অতএব, প্রাচীন কালের মতো একালেও রাজনেতারা মূল্যবোধ ও আদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েই সফল হতে পারবেন। জনকল্যাণকর পথে চলেই তারা তাদের কৃতিত্ব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অঙ্কিত করতে সমর্থ হবেন। কাজটি করা অবশ্যই সকল রাজনীতিবিদের পক্ষে সহজ বা সম্ভব হয় না। সকল রাজনীতিবিদই স্বকীয় দক্ষতায়-সাফল্যে ইতিহাসের শীর্ষচূঁড়ায় আরোহণও করতে পারেন না। কেউ হন রাজা বিন্দুসার; কেউবা সম্রাট অশোক। জনকল্যাণের স্পৃহা ও সাহস, সহিষ্ণুতা, উদারতা ইত্যাদির বিবেচনায় লিপিবদ্ধ হয় সাফল্য। বাগাড়ম্বর, আত্মকলহ, উগ্রতা, একগুয়েমি, হঠকারিতায় কৃতিত্ব আসে না।

রাজনীতির ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাটিও পাওয়া গেছে যে, বাগাড়ম্বর, বিবাদ, ষড়যন্ত্র, আত্মকলহ, উগ্রতা, একগুয়েমি আর হঠকারিতার বিস্তার লাভ করলে  রাজনীতির মাঠে-ময়দানে শেষ পর্যন্ত কেউই জিততে পারে না। সকল পক্ষেরই বিপুল ক্ষতিই হয়। বহু মানুষও আক্রান্ত হয় নেতৃত্বের ক্ষুদ্রতা, হীনতা, মূল্যবোধ ও আদর্শ বিচ্যুতির কারণে। রাজনীতির সংকট তখন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক ক্ষেত্রে তীব্রতর সংঘাতে পরিণত হয়। সমাজ আর মানুষের মর্মমূলে আশার বদলে নৈরাশ্যই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এমনই রাজনৈতিক সংকট আর সংঘাত থেকে উৎসারিত নৈরাশ্যকে ভর করেই পৃথিবীতে ভয়াবহ যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, বিপ্লব হয়েছে। রাজনীতিবিদদের অসতর্কতা বা উদাসীনতা বা একগুয়েমির স্থানে মূল্যবোধ ও আদর্শ থাকলে পৃথিবীর দেশে দেশে সাধারণ মানুষকে এতো মূল্য দিতে হতো না। সম্প্রীতি ও শান্তির জায়গাটি যুদ্ধ ও রক্তপাত এসেও দখল করতে পারত না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে সমীক্ষা করে রচিত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ লোয়েম ডিকিনসন-এর বই ‘দ্য ইন্টারন্যাশানাল এনার্কি (১৯০৪-১৯১৪)’ দাবি করেছে যে, যুদ্ধ ও সংঘাতের জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা এবং তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া মূল্যবোধ ও আদর্শ বিরোধী নেতিবাচক উত্তেজনা, যার নাম এনার্কি বা নৈরাশ্য। তিনি স্পষ্টতই লিখেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক যোগাযোগ কাঠামোয় বেশ কিছু চিড় দেখা গিয়েছিল। যে চিড় বা ফাটলকে ইংরেজিতে তিনি বলেছেন, ‘ফল্ট লাইনস’। কোনো দেশেও যদি রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে চিড় ধরে বা ফল্ট লাইন দেখা দেয়, তাহলে সেটা বিরাট বিপদের কারণ হয়। তখন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়ে; নিজের দলের নেতাদের মধ্যেও সন্দেহ আর বিভেদ বৃদ্ধি পায়। ফলত নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা কমে। সংঘাত-সংঘর্ষ প্রাধান্য পায়। অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক জট লাগে। রাজনীতির সমস্যা নানাবিধ অন্যান্য সমস্যার কার্যকারণে পরিণত হয়। এমন সমস্যা বিভিন্ন দলের মাধ্যমে হতে পারে। আবার একটি দলের ভেতরেও হতে পারে।

রাজা বিন্দুসার বিশ্বাসভঙ্গ করে নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মূল্যবোধ ও আদর্শহীনতার ফলে-সৃষ্ট সমস্যা তার শাসনে চিড় ধরিয়েছিল। ইউরোপের নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস আর ফাটল তৈরি করার মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে এনেছিলেন পৃথিবীর সামনে। একালের বহু দেশে বহু রাজনীতিবিদ মূল্যবোধ ও আদর্শহীনতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফাটল সৃষ্টি করে নিজের পতন আর জনতার সংকট সৃষ্টি করেছেন এবং করছেন। মধ্যপ্রাচ্য, আরব বিশ্ব, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ায় ঘন ঘন শাসন বদল, গৃহযুদ্ধ, জনতার মধ্যে রক্তপাত এবং বিদেশি অনুপ্রবেশের প্রধানত কারণই হলো সেসব দেশে মূল্যবোধ ও আদর্শহীনতার দ্বারা সৃষ্ট রাজনৈতিক ফাটল। রাজনৈতিক সঙ্কট আর লড়াই যখন বিরাট ফাটল তৈরি করে তখন ভেতর কিংবা বাইরে থেকে বিপদ এলে ঠেকাবে কে? যে রাজনৈতিক শক্তি জনতাকে নিয়ে রক্ষার কাজ করবে, তারাই যদি নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে একে অপরের ক্ষতির কারণ হয়, তখন পরবর্তী আরো অনেক ক্ষতির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদী দুর্ভোগেও পথ তৈরি হয়।

একালের রাজনীতিবিদরা এসব কথা জানেন বটে। ইতিহাসের পাঠ তাদের নেই, এটা বলা যাবে না। তারপরেও তারা এমন ভুল কাজই করেন কেন? আস্থা, বিশ্বাস, প্রজাহিত, নাগরিক শান্তি ও নিরাপত্তা, কল্যাণ, সুশাসন ইত্যাদির মতো পরীক্ষিত মূল্যবোধ ও আদর্শের পথে চলে রাজনীতিকে দৃঢ় করার বদলে ফাটল তৈরির কাজ করেন কেন? কেন জনদুর্ভোগের মতো নানা পরিস্থিতি আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে মোকাবেলার বদলে কাল-বিলম্ব করেন? কিংবা সমস্যা সম্পর্কে বেফাঁস কথাবার্তা বলে পরিবেশ বিষিয়ে তোলেন?

তিনি যে-ই হোন, যে দলই করুন, যে পদেই থাকুন না কেন, আস্থা, বিশ্বাস, প্রজাহিত, নাগরিক শান্তি ও নিরাপত্তা, কল্যাণ, সুশাসন ইত্যাদি চিরায়ত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শের বাইরে থাকতে পারেন না। রাজনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে সফল করতে হলে রাজনীতির এসব পরীক্ষিত-প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও আদর্শকেই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।