রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কখনো একটানা ঝিঁঝি ডাকত, কখনো চাঁদটা মাথার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যেত পুব থেকে পশ্চিমে, কিংবা পশ্চিম থেকে পুবে। কখনো নিকষ কালো অন্ধকার।
আমি যে সময়ের কথা বলছি- তখনো উভলঙ খালের মুখে স্লুইসগেট বসেনি। তখনো প্রায় প্রতিবছর বন্যা হতো। বন্যার জল কখনো উঠোন পেরিয়ে আমাদের ঘরের দাওয়া ছুঁই ছুঁই করত। তলিয়ে যেত পথঘাট। না, সে সবে আমাদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। রাতে ঠিকই আমরা আড্ডায় বসে যেতাম।
তখনো আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি। রাত ৯-১০টার মধ্যে সুনসান হয়ে যেত চারপাশ। সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আর আমরা বসে থাকতাম মন্দিরের বারান্দায়।
সেই কৈশোরে, তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে আমাদের বড় কোনো চাওয়া ছিল না, বড় কোনো স্বপ্নও ছিল না। আমরা হয়তো অবচেতনে ভেবেছিলাম- দিন এভাবেই যাবে।
না, দিন সেভাবে যায়নি। জীবন বোধহয় কখনো সরল পথে চলে না। এর বাঁকে বাঁকে থাকে বেহিসাবি টান। সেই টানে একদিন আমাকে শহরে চলে আসতে হয়। তার কিছুদিন পরে সেই টানে একদিন দোলনদা চলে যায় দুবাই, টুটন আবুধাবি।
দুই-তিন বছর আগের এক রাত। আবার সেই শিবমন্দির। বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত চারপাশ। দোলনদার অন্তিমযাত্রায় এসেছেন অনেক মানুষ। ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন অনেক দিন থেকে। বিদেশ থেকে যখন শেষবার ফিরেছিলেন তখন দুটি কিডনিই শেষ।
তখন গাছে গাছে পাকা আম। দোলনদার নশ্বর দেহটা যখন চিতার আগুনে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, তখন চারপাশের গাছ থেকে ঝরে পড়া একেকটা আম কুড়িয়ে এনে শোকে অচেতন মায়ের পাশে জমা করছিল দোলনদার চার-পাঁচ বছর বয়সী ছোট ছেলেটা। পিতার মৃত্যু কী-এটা বোঝার বয়সই হয়নি তখন শিশুটির।
এর বছরখানেক পরের কথা। সেদিনটি ছিল ২৬ মার্চ। আমাদের বাড়িতে পরিবার সম্মিলন। বাড়ির লোকজন যে যেখানে থাক এসে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। আমিও গিয়েছিলাম। বাড়ির অদূরে বিলের মাঝে শামিয়ানা টাঙিয়ে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, স্মৃতিচারণ। আমি এসব থেকে নীরবে চলে যাই টুটনদের ঘরে। মাস দুয়েক হবে সে ফিরে এসেছে আবুধাবি থেকে। এর মধ্যে ভারত থেকেও ঘুরে এসেছে। তাকে পেলাম তাদের শোবার ঘরে, শুয়ে আছে। সুঠাম শরীর এখন একেবারেই শীর্ণ। কেমন আছিস-কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করিনি। এই প্রথম মনে হলো এ সাধারণ, অতি সাধারণ প্রশ্নটাও সব সময় করতে নেই। আমি তার মাথায় হাত রেখে বলি, অনুষ্ঠানে যাসনি?
: গিয়েছিলাম, দুর্বল লাগছিল। চলে এসেছি।
আমি তার পাশে শুই। যে আমরা কত কত রাত কথা বলতে বলতে ভোর করে ফেলেছি, সেই আমরা অনেকক্ষণ কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
একসময় সে বলে, এখন এক বৈদ্যের ওষুধ খাচ্ছি।
: কেমন লাগছে?
: আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গেছি তো।
: ইন্ডিয়ার ডাক্তাররা কী বলেছে?
: ধুর, ওরা আমার রোগই ধরতে পারেনি। শুধু এ পরীক্ষা সে পরীক্ষা করে আমার সময় আর অনেক টাকা নষ্ট করেছে।
দেখলাম, তার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস বৈদ্যের ওষুধ খেয়েই সে সুস্থ হয়ে উঠবে, আবার বিদেশ যাবে। বৈদ্যে আমার ভরসা না থাকলেও তার আত্মবিশ্বাস আমাকে আশান্বিত করেছিল। কত কাহিনিই না পড়েছি- মনোবল আর আত্মবিশ্বাসে কঠিন কঠিন অসুখকে পরাভূত করার।
এর মাসখানেক পরে আরেক রাতে আবার সেই শিবমন্দির চত্বরে বসে আছি।
ফুসফুস ক্যানসারের সাথে লড়ে জিততে পারেনি টুটন।
লেখক: দিবাকর ঘোষ, সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৭
টিসি