সেদিন যেকোনো কারণে ওই শিশুটির পা পিছলে বড় বিপদ হতে পারত, কারণ তার আশেপাশে ধরার মতোও কিছু ছিল না। ছিল না কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থাও।
বাসার ছোট্ট কাজের শিশুকে দিয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করানোর খবরটি ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন মিডিয়ায়। গৃহকর্তা কীভাবে ছোট্ট কাজের শিশুকে দিয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করাতে পারলেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন অনেকেই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অমানবিক এ বিষয়টি সবার সামনে প্রথম তুলে ধরে মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চল। শুধু সবার সামনে তুলে ধরেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেনি মানবাধিকার কমিশন। বরং পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় গৃহকর্মী রিমার বাবা-মাকে ৬ আগস্ট (রোববার) রাতে ডেকে চকবাজার থানায় সমস্ত আইনকানুন মেনে মেয়েটিকে তার বাবা-মার কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করে।
এ কাজে সহযোগিতা করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি এবং এডিসি সাউথ। মূলত তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় মানবাধিকার কমিশন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। এভাবে কল্যাণের কাজে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর উদাহরণ তৈরিতে মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চল একের পর এক প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।
এখানে যে মানুষগুলোর সচেতনতায় শিশুশ্রম থেকে রক্ষা পেল রিমা নামের ছোট্ট শিশুটি, তাদের কথা তো বলতেই হয়।
ইয়াসির আরাফাত, সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করছেন বহুদিন। বিষয়টি ঘটনার দিন প্রথম খেয়াল করেন তিনি। মোবাইলে ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করেন। তার সেই স্ট্যাটাস দেখে মানবাধিকার চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আমিনুল হক বাবু সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাজে নেমে পড়েন।
তাৎক্ষণিকভাবে রিমাকে দেখতে যান এবং বাসার মালিককে বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেন। বাসার মালিক অতীব লজ্জা পেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, মেয়েটিকে তারা এক মিডিয়ার মাধ্যমে পেয়েছেন। তবে মেয়েটির বাবা-মা সুদূর হাতিয়ায় থাকেন এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করে তিনি মেয়েটিকে হস্তান্তর করবেন। রিমাকে শিশুশ্রম থেকে মুক্তি দেবেন।
এরই মাঝে বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হলে ডিসি সাউথ মোস্তাইন হোসেন এবং এডিসি সাউথ আব্দুর রউফ চকবাজার থানার ওসি নুরুল হুদাকে নিয়ে একটি প্রশংসনীয় বৈঠকের আয়োজন করেন। পুলিশ প্রশাসনের সময়োপযোগী উদ্যোগে বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব পায় সবার কাছে। অবশেষে মেয়েটির বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া গেলে তাদেরকে চট্টগ্রামে আনানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। রোববার তাদের কাছে রিমাকে হস্তান্তর করা হয়।
আমরা মানবাধিকার কমিশন চেয়েছিলাম আমাদের খরচে মেয়েটিকে চট্টগ্রামের কোনো আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় রেখে অন্তত আলিম পর্যন্ত পড়াশোনা করানোর। কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক পিতা চাননি মেয়ে তার কাছ থেকে দূরে থাকুক। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন প্রয়োজনে ভিক্ষা করে মেয়েকে বড় করবেন।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, রিমার বাবা-মা আর তার শ্রম বিক্রি করবেন না। রিমার ভবিষ্যত চিন্তা করে তিনি আমাদের ফোন করবেন এবং বলবেন আপনারা আমার মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিন। আমি নিশ্চিত সেদিন আমাদের পাশাপাশি পুলিশের হৃদয়বান ডিসি (সাউথ) এবং এডিসি (সাউথ) কে পাশে পাব, পাশে পাব যে বাসায় রিমা কাজ করতো সেই বাসার কর্তাকে।
এরকম বহু রিমা অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় শিশুশ্রম বিক্রি করছে। সামান্য কিছু টাকার জন্য তাদের ভবিষ্যত নষ্ট করছে অভাবগ্রস্থ, কখনো বা লোভী পরিবার। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা কোনো শিশুশ্রমকে উৎসাহিত করতে পারি না। দেশের ৮০ লাখ শিশু শ্রমিকের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা।
একজন রিমাকে মুক্ত করেই কাজ কিন্তু শেষ হয়নি। উই হ্যাভ এ লং ওয়ে টু গো...
লেখক: ভিপি, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, চট্টগ্রাম অঞ্চল।