একবার ইলিশ খেতে বড্ড ইচ্ছে করলো। আশে সোনালি ঝিলিকওয়ালা সত্যিকারের মাছের রাজা।
আমন্ত্রন অনেককে-ই জানানো হলো। ইলিশের কথা শুনে সবাই এক কথায় রাজি। কিন্তু সোজাসুজি হাঁটাপথে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটারের ধাক্কার হুমকিতে বাকি সবাই স্যারেন্ডার। হারাধনের অনেক ছেলে রইলো বাকি দুই। আমি আর জুয়েল থিওটিনিয়াস।
এক ছুটির দিনে অনেক কষ্টে ঘুম থেকে উঠে বাবুবাজার ব্রিজে। জুয়েল ভাই আগেই এসে উপস্থিত। কেন যেন ভয় ভয় করছিলো। একদিনে চল্লিশ কিলোমিটারের উপর হাঁটা। মুখের কথা না। তবে ভরসা এটাই যে আগে একদিনে এতটা পথ কখনও হাঁটিনি। তাই পথ কষ্ট সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।
সকালের রোদ ঝলমল করে উঠলো। তার আলোয় বুড়িগঙ্গা তীরের জীবন জেগে উঠেছে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। কেরানীগঞ্জ বাজার হয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য মাওয়া রোডে ওঠা। মোটামুটি চল্লিশ-পঁয়াতাল্লিশ মিনিটের মধ্যে মাওয়া সড়কে উঠে গেলাম। রাস্তার পাশের কিলোমিটার পোস্ট জানালো মাওয়া ৩৫ কিলো। সকালের রোদের মিঠে আলো কড়া চোখ রাঙায়নি বলে বেশ জোরছেই হাঁটছি। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ঠেলায় কাটা পড়েছে রাস্তার পাশের ছায়াদায়ী গাছগুলো। বেশ ভালোই বোঝা গেলো বেলা বাড়লে উপরে সূর্য আর নিচে পিচের ঠেলাঠেলিতে জান ওষ্ঠাগত হবে।
আমরা সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে আবদুল্লাহপুর বাজারে চলে এলাম। সকালের নাস্তার বিরতি। আধ ঘণ্টাখানেক পরে যখন ফের রাস্তায় নামলাম আসল খেলা শুরু হলো। ততক্ষণে ধলেশ্বরী ব্রিজ পার হয়ে চলে এসেছি মুন্সীগঞ্জের সীমায়, সিরাজদীখান। রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ চলছে। পাশ দিয়ে হাঁটারও জো নেই। তারওপর কানে বাতাস লাগিয়ে শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে দানবাকৃতির একেকটি বাস। এর একটার সঙ্গে সামান্য ছোঁয়া লাগলে এ জনমে আর ইলিশ মাছ খাওয়ার ভাগ্য হবে না।
প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে যুদ্ধে, ক্লান্তি নেমে আসছে পুরো শরীর জুড়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছি, পানি খাচ্ছি তারপর আবার চলা। পায়ের পেশিতে বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা গেলো। রাস্তার এবড়ো থেবড়ো অংশে হোঁচট খেয়ে ডান পায়ের শিরায় টান পড়লো, ককিয়ে উঠলাম। পানিশূন্যতার ফল। বসে ক্ষানিকক্ষণ বিশ্রাম, পানিপানের বিরতির পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা। বেলা দুইটার পরে আমরা এসে পৌঁছালাম মাওয়ার পুরনো ঘাটে। এখানে এখন পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। ঘাট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে। আমরা সে অবধিও হেঁটে যাবো বলে ঠিক করলাম। শেষ পর্যন্ত নতুন মাওয়া ঘাটে যখন পৌঁছালাম ক্ষুধা ক্লান্তিতে শরীর চলছে না। কিন্তু তৃপ্ত, পারলাম তো!!।
ঢুকে গেলাম নদীর পারে এক হোটেলে। শরীর এতোই ক্লান্ত যে ক্ষুধা পাওয়ার শক্তিও লোপ পেয়েছে। হোটেল বয় যখন জানলো আমরা সেই ঢাকা থেকে হেটে এসেছি, বাড়তি খাতির তার কাছ থেকেও। মাওয়ার এই হোটেলগুলোয় ইলিশ মাছের বোধহয় কোনোদিন কমতি হয় না। যখনই যান ইলিশ পাবেনই। দুটো করে ইলিশের পেটি অর্ডার করে দিলাম, আছে ইলিশের ডিম। সঙ্গে বেগুন ভাজা, গরম ভাত, ডাল।
হোটেলবয়ের সৌজন্যে সেদিন প্রথমবারের মতো খেলাম ইলিশের ভর্তা। সাক্ষাৎ অমৃত!! কিন্তু একি খেতে গিয়ে গলা দিয়ে আর অমৃতসম এসব খাবার নামছে না। অতিরিক্ত ক্লান্তির ফল। ভাত বাদ দিয়ে শুধু ইলিশের আইটেমগুলো খেলাম। সদ্য গরম তেলে ভাজা ইলিশ, অন্য সময় হলে নির্ঘাত হোটেল সাবাড় করে দিতে পারতাম।
পদ্মার ইলিশ খেয়ে সেই নদীর পারে বসে শেষে বিকেলের আলোয় জীবনযজ্ঞ দেখাও ইলিশ খাওয়ার মতোই দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমরা সাধ্যের ক্ষানিকটা বেশিই পরিশ্রম করে ফেলেছি। তাই খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢাকাগামী বাসে উঠতে হলো। আহা জীবন কত সুন্দর!
বাংলাদেশ সময়: ০৪১২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
এএ