বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিশোধ। স্নায়ুযুদ্ধের একটি পরিণতি ও দেশীয় লোভী বিশ্বাসঘাতক-দালালদের ঘৃণ্যকর্ম।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রথমভাগে বঙ্গবন্ধু সরকারের দুর্নাম ছড়ানো হয়। হলুদ সাংবাদিক, দুর্নীতিবাজ আমলা, অসৎ রাজনীতিক, উচ্চাভিলাসী সেনা, কালোবাজারি ব্যবসায়ীরা এই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজ সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করে। এই শয়তানের দলের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের আখের গোছানো। ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রীরা এগিয়ে যায় তাদের শেষ আঘাত হানতে।
রেডিওতে ভেসে আসে খুনি ডালিম, মোশতাকের কণ্ঠস্বর, ‘মুজিব মৃত, বাংলাদেশ এখন ইসলামিক রিপাবলিক। ’
বাঙালির নিকৃষ্ট এই সন্তানরা সেদিন মেতে ওঠে উৎসবে। পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' ধ্বনি প্রায় সাড়ে তিনবছর পর ফের শোনা যায়, পাকিস্তানপন্থিরা আবার বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে।
কেন সপরিবারে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল? এর উত্তরটি জটিল কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁকে শেষ করতে হলে সমূলে করতে হবে- এই কথাটুকু বিশ্বাস করতো কাপুরুষ খুনিরা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে খুনিরা এমনভাবে হামলা চালিয়েছিল যেন, সেটি কারো বাসস্থান নয়, মহাকুরুক্ষেত্র।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি আর ষড়যন্ত্রীরা এতোটাই ভয়ে ছিল যে, খন্দকার মোশতাকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বঙ্গভবনে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়।
চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, পাবনা, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে জনতা। অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। সংগ্রামে শহীদ হন তাদের অনেকেই। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা সহ্য করেছেন কারাগারের নির্যাতন। সে সময়টি ছিল পাকিস্তানের প্রেতাত্মার কাছে পুনরায় আত্মসমর্পনের অন্ধকার সময়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধ সংগ্রাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেভাবে হয়নি বলে, ভারত ও রাশিয়া থেকে প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাল ওই সময়গুলোতে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে কিছু করা সেভাবে সম্ভবপর ছিল না।
একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবের জন্য সেদিনটি ছিল মহা আনন্দের। পরাজয়ের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ঘরে বিজয় তুলে নিয়েছিল। সেদিন থেকে বাংলাদেশ আবার পেছনে হাঁটা শুরু করে। স্বাধীন-সার্বভৌম হয়েও বাংলাদেশ পরিণত হয় পাকিস্তান ও তার মিত্রদের ছায়ারাষ্ট্রে।
ষড়যন্ত্রী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ পাঠ করান বিচারপতি সৈয়দ এ.বি. মাহমুদ। সামরিক বাহিনীর তৎকালীন তিন প্রধান উপস্থিত ছিলেন সেখানে। অারো ছিলেন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সংসদ সদস্যরা।
কি নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা! বাংলাদেশ, বাঙালি আজো এই বিশ্বাসঘাতকতার মাশুল দিয়ে যাচ্ছে....।
সাব্বির হোসাইন: পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধ ই-অার্কাইভ ট্রাস্ট
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
জেডএম/