সত্যি কথা বলতে, শ্রাবণের এই পড়ন্ত লগ্নে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের কষ্ট আর ভালোবাসাও যে আর বাঁধ মানে না। এমন শোকের দিন, এমন শোকের মাস, নিজেকে এবং নিজের অস্তিত্বকে হারানোর এমন মুহূর্ত, বাঙালির জীবনে বোধ হয় আর কখনো আসেনি।
কী অদ্ভুত আমরা বাঙালিরা। কতটা স্বার্থপর আমরা। নাকি অজ্ঞতা আমাদের? যে মানুষটা জীবনের ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাগারের অন্ধকারে কাটিয়েছেন আমাদের জন্য, আমরা তাকে হত্যা করলাম? যেই মানুষটা সারাটা জীবন আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ করে গেলেন, আমরা তাকে নিঃশেষ করে দিলাম। আজও মনকে প্রশ্ন করি, কেন? সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া ১৯৭২ সালের এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু স্বীকার করেছিলেন যে, তার সবচেয়ে বড় শক্তি, তিনি এদেশের মানুষকে ভালোবাসেন এবং সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তিনি এদেশের মানুষকে একটু বেশি ভালোবাসেন। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই বেশি ভালোবাসাটাই বুঝি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়ালো।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু সবার থেকে একটু আলাদা ছিলেন। তার জীবনী থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর ‘এক মুখ নানা রূপ’ দেখতে পাই। কখনো ‘সাহসী খোকা, কখনোবা বিদ্রোহী মুজিব, লাখো মানুষের ভালোবাসার বঙ্গবন্ধু কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা’। সারাটা জীবন তিনি লড়েছেন শুধু বাংলার মানুষের অধিকারের জন্য। সেটা স্কুলের ছাদ মেরামত এর জন্যই হোক, কিংবা নিজের ভাষায় মা ডাকের অধিকারের জন্য; কখনো ছয় দফার দাবি নিয়ে অথবা মুক্তির সংগ্রামের সাহস জুগিয়েছেন তিনি সাত কোটি বাঙালির প্রাণে। স্বাধীনতার জন্য তিনি নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু।
সাধারণ মানুষের চোখে অসাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব। যিনি চাননি কোনো কিছুই নিজের জন্য, কিন্তু নিজের সবটুকু উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের জন্য। কোনো অবস্থায়ই তিনি মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধু কখনো লজ্জিত করেননি নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমরা শুনেছি, মৃত্যু যখন একেবারে দ্বারপ্রান্তে, তখনও বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে, দুইবার মরে না। ’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যু আসে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না এবং যাবার সময় বলে যাবো- জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। ’ বঙ্গন্ধুর ভরাট গলায় সেই দিনের এই কথাগুলো গর্বে বুক ফুলিয়েছিলো অসহায় সর্বহারা যুদ্ধবিধ্বস্থ সাত কোটি বাঙালির।
দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু দেশ গোছাতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। গড়ে তুলতে হবে সোনার বাংলা, তৈরি করতে হবে সোনার মানুষ। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। ’ সোনার বাংলা গড়তে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন তিনি বিশ্বমানবতার কাছে। তবে ভিক্ষা চাননি। সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন, তবে দেশ বিক্রি করেননি কোনোভাবেই।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। তাই প্রথমেই তিনি বাংলার মাটিকে সকল পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিলেন। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর অনুরোধেই ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দুই দিন আগে বাংলাদেশ থেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্যবাহিনীক, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আজও আমরা দেখতে পাই প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই মিত্র বাহিনীর উপস্থিতি। পৃথিবীর যেকোনো দেশের স্বাধীনতায় যখন কোনো মিত্র বাহিনী সাহায্য করে, তখন যুদ্ধ শেষে সে দেশ নিজেদের কিছু সৈন্য সবসময় স্বাধীন দেশে দায়িত্বরত রেখে যায়। তাকিয়ে দেখি আমরা জাপানে, কোরিয়ায় ও ভিয়েতনামে, মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয়নি, কারণ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের আগেই বুঝে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ন্যাম সামিটের ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সাক্ষাত হয়েছিল। এক পর্যায়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে এ দেশের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ করার কথা বলেন ফয়সাল। তার উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনার দেশের নাম তো বাদশাহ সৌদ এর নামে রাখা হয়েছে, তবে আমাকে কেন একটি বিশেষ ধর্মের নামে আমার দেশের নাম রাখার কথা বলছেন? আমার বাংলাদেশে এক কোটিরও বেশি মানুষ অন্য ধর্মের। বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা ছিল আমি বিশ্বাস করি ‘লা কুম দি নোকুম ওয়াল ইয়া দিন’ অর্থাৎ ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’। ’ এই ছিলেন আমাদের জাতির পিতা, যিনি প্রকৃত ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন মানবতার ধর্মে।
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ছিল প্রবল। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ করে। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে যোগদান করেন। তিনিই প্রথম জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেননি, তার সঙ্গে সঙ্গে সম্মানিত করেছেন সকল ভাষাসৈনিক ও বাঙালিকে, যারা লড়েছেন এই ভাষার জন্য।
যেই বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু এতো ভালোবাসতেন, সেই বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে চেনেনি, তবে চিনেছিলেন বিশ্বনেতারা। সদ্যপ্রয়াত ভারতীয় বিজ্ঞানী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন ঐশ্বরিক আগুন এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানাযুক্ত করতে পেরেছিলেন। ’
বিলেতের মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রয়াত নেতা মনীষী লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছিলেন, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। ’ যুক্তরাষ্টের নিউজউইক পত্রিকা লিখেছিল ‘শেখ মুজিব রাজনীতির কবি (পোয়েট অব পলিটিকস)। ’
খ্যাতিমান সাংবাদিক সিরিল ডানের ভাষায়, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। ’
ন্যাম সম্মেলনে বিপ্লবী রাষ্ট্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সেই ঐতিহাসিক তুলনা আজও আমাদের গর্বিত করে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখেনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো। তার মধ্যেই আমি হিমালয়কে দেখতে পেরেছি। ’ দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। আমরা আমাদের হিমালয়কে হারিয়েছি আমাদেরই দেশের কতিপয় হায়নার হাতে।
তবে আজ তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়, যখন আমরা দেখি, ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এমন কিছু মানুষের হাতে, যারা মানবতা ও আইনের কথা মুখে বলে, যারা সুশাসনের কথা বলে আজও দুঃশাসনের পথই বেছে নিয়েছে। সঠিক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘোষিত বিচারের রায়কে অমান্য করে, খুনিদের মদত যোগায়। বিভিন্ন আইনের মারপ্যাঁচে প্রশ্রয় দেয় অন্যায়কে, অপরাধীকে। তারা ভুলে যায় সহস্রকাল পুরানো সেই বাক্যবুলিকে, ‘পাপ কারও বাপকেও ছাড়ে না। ’
তবে, এই সব প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের ভরসা একটাই, আজও আমাদের পথ দেখানোর জন্য আলোর সোনালি মশাল হাতে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু যে বাবা ও পরিবারের হত্যার বিচার করেছেন তিনি, তা নয়, একইসঙ্গে বিচার করে চলেছেন সব মানবতাবিরোধী অপরাধের। সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যার এই দৃঢ় পদক্ষেপ ও সাহস অবাক করেছে বিশ্ববাসীকে। কোনো অন্যায় আবদার বা ভয়ে পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু কন্যা। নিরলসভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সব বাধাকে পরাস্ত করে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজে, সঙ্গে পূরণ করছেন বাবার দেখা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন।
আজ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ, একটি রোল মডেল। সফলতার সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন শেষে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের দিকে। বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মানুষের মাথাপিছু আয়, কর্মসংস্থান, খাদ্য উৎপাদন, বৈদেশিক রপ্তানি, নেমে এসেছে মুদ্রাস্ফীতি, দারিদ্র্যের হার, বৈদেশিক আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা। সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও মৌলবাদী শক্তির উত্থানকে দমন করা সম্ভব হয়েছে অনেকাংশে। কমেছে বিনিয়োগভীতি, ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দ্বার।
সর্বত্র নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, নিম্নমুখী শিশু মৃত্যুর হার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ও ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, প্রতিটি ঘরে উন্নয়নের আলো, মধ্যম আয়ের উন্নত বাংলাদেশ, নগরে মেট্রোরেলের গতি আজ আর ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রূপকথার গল্প নয়। আজ সত্যি বাংলাদেশ- ‘সারা বিশ্বের বিস্ময়’।
বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, নতুন প্রজন্মের আলো, নানার স্বপ্নের সঙ্গে একাত্মতায় দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে দিয়েছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। আজ এদেশের তরুণেরা আবারও স্বপ্ন দেখে সোনালি আগামীর। ফিরে আসে নিজ দেশে নতুন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে। এ প্রজন্ম আজ আবার বিশ্বাস করে সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। তাই নিজেদের সোনার মানুষ হিসেবে তৈরি করে তারা মিশে যেতে চায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঙ্গে। আজ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে শুধু একজন বঙ্গবন্ধু নন, ধ্বনিত হয় গৌরী প্রসন্ন মজুমদার সেই কালজয়ী কথায়, ‘… একটি মুজিবরের থেকে, লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। ’
এতো সব কিছুর পরও, কেমন যেন একটি শূন্যতা আজও রয়ে গেছে। রয়ে গেছে হাহাকার। যার কারণে এতো সব কিছু, সেই মানুষটাই আজ নেই। কেমন লাগে বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের? প্রতিবছর এই মাসটা কিভাবে পার করেন বঙ্গবন্ধুর ‘আদরের হাসু’ আর ‘ছোট্ট রেহানা’। ভেবেছি কি আমরা একবারও কখনো? আর তাই বুঝি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই প্রতিবছর এই সময় প্রকৃতির এই রূপ। রবি ঠাকুরের কথায়, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে’।
লেখক
কানতারা কে খান
যুগ্ম-আহবায়ক, সুচিন্তা বাংলাদেশ
কলাম লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
এইচএ/