বাঙালির গোলামীর ইতিহাস সুদীর্ঘ ও প্রাচীন। লক্ষণ সেনের পর ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো বাঙালি নেই।
আপত্তি থাকলেও আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রধানমন্ত্রিত্ব দুই বড় দলের দুই নেত্রীর হাতেই ঘুরে ফিরে আসবে। একজনের বিরুদ্ধে উষ্মায় অন্যকে টেনে তুলে আনা হবে ক্ষমতার মসনদে। অতীত কর্মকাণ্ডের বাছ-বিচারের বিস্তারিত বিবরণে যেতে চান না অনেকে। ক্ষমতায় থাকাকালে নেত্রীরা যে ভাষা ও সুরে কথা বলেন, বিরোধী দলে গেলে সেই ভাষা বেমালুম গায়েব। সেই সুর ছন্দ হারানো ‘বিরক্তি’। দু’জনেরই প্রিয় ‘স্টারডম’। হাজার হাজার মানুষের ঢল। হাততালি। তাদের নামে জিন্দাবাদ। রূপালী পর্দার হৃদয় কাঁপানো তারকার চেয়ে বহুগণ বেশী জনপ্রিয়তার মোহে উনারা দু’জন বেশ মোহাবিষ্ঠ। নিজেকে নিঃসন্দেহে উনাদের মালুম হয় সৃষ্টির সেরা জীব! শ্রেষ্ঠ বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী!
ক্ষমতার সাথে দায়িত্ব আসে। ক্ষমতার বিস্তার যতো বড়, দায়িত্ব ততো বেশী বিস্তৃত্ব ও কঠিন। আমাদের দুই নেত্রী কেবল ক্ষমতা প্রত্যাশী। দায়-দায়িত্ববোধের কোনো বালাই দেখি না। দায়-দায়িত্বের সংজ্ঞা উনারা নিজেরাই নির্ধারণ করেন। উনাদের দায়িত্ব দেখি দলীয় নেতাদের উছৃংখলাকে, বাচাল কথাবার্তাকে, ক্ষমতার অপচয় ও ব্যর্থতাকে আড়াল দেওয়ায়। দলীয় ক্যাডারদের ‘বাড়াবাড়ি’ যতোটা সততার সাথে নিজ ’দায়িত্বে’ নেন, ততোটা না-হলেও তা অংশবিশেষ নিলেও জনগণ বেশ উপকৃত হতো। দেশের এক-কদম-এগিয়ে-দুই কদম-পেছানো গণতন্ত্র উপকৃত হতো। দায়িত্ববোধ থাকলে গেলো কুড়ি বছরের জাতীয় সংসদ হয়ে উঠতো আলোচনা-সমালোচনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদ হতো দেশের মানুষের প্রাণভোমরা।
লাগাতার বর্জনের সংস্কৃতিতে বহুদিন ধরেই জাতীয় সংসদ একদলের নেট প্র্যাকটিস ম্যাচের ময়দান। অন্যদল রাজনীতির চর্চা করেন যানজট লাগিয়ে, জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে রাজপথে। প্রক্রিয়াটি মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো পাঁচ বছর পর পর বদলে যায়। গণতন্ত্রের চিৎকারে, রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতার সরকারের বদলে সংসদীয় স্বৈরাচার কুড়ি বছর ধরে বাংলাদেশকে আছন্ন করে রেখেছে। দলীয় ফোরামে দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবার বদলে নেতৃত্ব পিকড-আপ হয়েছে বারবার। দলীয় প্রধানের সানুগ্রহেই রাজনৈতিক নেতৃত্বদের বিকাশ ও উত্থান।
এতেও কোনো আপত্তি ছিলো না। প্রতিবাদে দুর্নীতির চর্চা কমে না। তবু জিডিপি’র সামান্য অগ্রযাত্রায় সন্তুষ্ট থাকি আম-জনতা। কিন্তু যখন-তখন বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও সরকারের কাছে একে অপরের নামে `কুটনামি` দেখি, তখন মাথা গরম হয়ে যায়। র্যাব’র জন্মদাতা ও সেনাবাহিনীর ’ভাবীজান’ বেগম জিয়া র্যাব ও সেনাবাহিনীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার শেষে এখন বিদেশিদের কাছে সেনাবাহিনী ও র্যাবের বিরুদ্ধে `কুটনামিতে` নেমেছেন। র্যাবকে বিদেশিরা প্রশিক্ষণ দিলে দেশের কী ক্ষতি হয়? সেনাবাহিনী জাতিসংঘে আরো বেশি সৈন্য পাঠালে আওয়ামী লীগের কী লাভ বা বিএনপি’র কী ক্ষতি হয়? র্যাব যদি নিয়ম বহির্ভূত কাজ-কারবারে লিপ্ত হয়, তাহলে র্যাবকে নিয়ন্ত্রণের দায়-দায়িত্ব সরকার ও বিরোধী দলের। বেগম জিয়া প্রতিশ্রুতি দিক, বিএনপি আবার নির্বাচিত হলে র্যাবের হাতে কোনো প্রাণ যাবে না। যদি র্যাব কোনো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাহলে বিএনপি সরকার তার দায়-দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করবে। কিন্তু র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়াতে বাধা দেবেন কেন?
বেগম জিয়ার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে সেনাবাহিনীর রেশন খেয়ে, সেনা কর্মকর্তা স্বামীর রোজগার খেয়ে সেনাবাহিনীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কেন নামবেন? সেনাবাহিনী যদি সামান্য ও বিপথে গিয়ে থাকে, তার দায়-দায়িত্ব বেগম জিয়াকেও বহন করতে হবে। কেননা উনি নিজে একসময় সরকারে ছিলেন আর সেনাবাহিনী ছিলো উনার অধীন। সেনাবাহিনীতে হুট করে কিছূ হয় না। সেনাবাহিনীর কাজকর্ম হয় চলমান প্রক্রিয়ায়। ক্ষমতায় যেতে না পারার ব্যর্থতায় বেগম জিয়ার সাধু ও ’চরিত্রবান’ হবার চেষ্টাটাকে অপচেষ্টা বলা যেতে পারে।
দায়িত্বশীল পদাধিকারীদের কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার ছাপ থাকতে হবে। থাকতে হবে দেশপ্রেম। বেগম জিয়ার ভাষণে দেশপ্রেমের বালাই ছিলো না। ছিলো ঘৃণার বিষ।
ইমেলঃ [email protected]