অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন পর্যন্ত মিয়ানমারের আরাকানের গণহত্যা ও জাতিগত নিধনকে বলেছিলেন ‘স্লো জেনোসাইড’ বা ‘মন্থর গণহত্যা’। ওই কথাটিও অনেকেই স্মরণ করছেন এই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে।
গণহত্যার প্রতিবাদে পৃথিবীজুড়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সু চি বিরোধিতার আওয়াজ বাড়ছেই। মুখ খুলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। সরব হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্দোগান।
বসনিয়া ও রোয়ান্ডায় গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে এর্দোগান বলেন, ‘মিয়ানমারের এ শোচনীয় পরিস্থিতি না পাল্টালে মানবতার ইতিহাসে ফের কালো ছাপ পড়বে’।
বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা রয়েছেন, তাদের অবিলম্বে মিয়ানমারে ফেরার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক- দাবি করেন এর্দোগান।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাও সমর্থন পাচ্ছে বিশ্ববাসীর। প্রশংসিত হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নানা কার্যক্রম। শরণার্থীদের প্রতিও নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ। উদ্বাস্তুদের জন্য নানা ধরনের সাহায্য সামগ্রী নিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশের ত্রাণবহর।
তবে সু চি-র ওপর চাপ যতোই বাড়ুক না কেন, পর্যবেক্ষকরা কিন্তু বলছেন, পরিস্থিতি আর তার হাতে নেই। দেশে ‘নির্বাচিত সরকার’ থাকলেও যে সেনাবাহিনী মায়ানমারকে অর্ধশতক ধরে শাসন করে এসেছে, তারাই এখনও ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে। ৭২ বছর বয়সি ‘জননেত্রী’র সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো ক্ষমতাই নেই। তিনি বরং সামরিক বাহিনীকে হাতে রাখতে ভারসাম্য নীতি গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতার প্রশ্নে তিনি জান্তার প্রতি নমনীয়তা অব্যাহত রাখার পথ ধরেই চলছেন।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা সু চির অবস্থানকে এভাবেই তুলে ধরছেন।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন প্রসঙ্গে বরং সামনে চলে এসেছে ‘মন্থর গণহত্যা’ নামক টেকনিক্যাল শব্দটি। বছর তিনেক আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রসঙ্গে আলোচনা সভায় অমর্ত্য সেন ‘স্লো জেনোসাইড’ বা ‘মন্থর গণহত্যা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। তখনও ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ ঘটেনি সু চি-র।
রোহিঙ্গা সমস্যা প্রসঙ্গে তখন অমর্ত্য বলেছিলেন, ‘অনেকেই হয়তো বলবেন, নাৎসি জার্মানি বা রোয়ান্ডার থেকে এ হত্যালীলা অনেকটাই আলাদা। কিন্তু এ কথা মানতে বাধা নেই যে, মায়ানমারে যা ঘটছে, তা গণহত্যাই। আর তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলছে নানা ধরনের বঞ্চনা-বাসস্থান না পাওয়ার বঞ্চনা, খাবার না পাওয়ার বঞ্চনা, কাজ না পাওয়ার বঞ্চনা, অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা না পাওয়ার বঞ্চনা। সব কিছুর ওপরে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার বঞ্চনা’।
তিন বছর পরেও সেই ‘মন্থর’ হত্যালীলা থামার কোনো দিশা দেখতে পাচ্ছে না বিশ্ব। দেখাতে পারছেন না শান্তিতে নোবেলজয়ী অন সান সু চিও। এক নোবেলজয়ীর দেশে চলমান অপরাধের চিত্র যখন আরেক নোবেলজয়ী চিহ্নিত করেন, তখন সাধারণ মানুষ আশা করেন ন্যায়সঙ্গত সমাধান।
রোহিঙ্গা সমস্যার রক্তাক্ত পরিস্থিতি থামাতে বিশ্বব্যাপী আওয়াজের সফলতা পেতে মনে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার দরকার হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-লেখক-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭
এএসআর