ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্মৃতির অবগাহনে শখের সাংবাদিকতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৭
স্মৃতির অবগাহনে শখের সাংবাদিকতা প্রতীকী

মেঝো মামা মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় শিক্ষক। হাড্ডিতে হাড্ডিতে চিকন বুদ্ধি। তার বাসায় নিয়মিত খবরের কাগজ আসতো। কিন্তু মন খুলে পড়ার সুযোগ পাইনি কখনো। তখন থেকেই মনে সাংবাদিক হওয়ার দানা বাঁধতে শুরু করে। মনে মনে বলি, মামা, একদিন রিপোর্টার হয়ে যেন আমার রিপোর্ট তোমাকে দিয়ে পড়াতে পারি।

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ভর্তি হলাম ফোকলোর বিভাগে।

সাবজেক্টের তেমন পরিচিতি নেই। যে যেভাবে পারে উচ্চারণ করে। কেউ ফকলুর, কেউ ফখলর, কেউ ফোল্কলোর কেউ বা আবার ঠাট্টার সুরে ফকাস্টিং মার্কা সাবজেক্টও বলে। কখনো ভালো লাগে, কখনো তাচ্ছিল্য মনে হয়। যে যাই বলার বলুক, আমি আমার মতোই চলি। জীবনে ছাড় দেয়ার চর্চা ঘর থেকেই শিখেছি।

যাই হোক, নাম লেখালাম সাংবাদিকতায়। দৈনিক জনতা পত্রিকা দিয়ে লেখালেখি শুরু। এরপর দৈনিক আজকের কাগজ। মামা তখন আজকের কাগজের একনিষ্ঠ পাঠক। মামা আমার সার্টিফিকেট নাম জানতেন না। হঠাৎ-ই একদিন নামের সঙ্গে খোকন লেখা দেখে মাকে ডেকে বলেছিলেন, ও কি সাংবাদিকতায় নাম দিয়েছে নাকি রে?
 
বাপের পকেটেই টাকা থাকতো না, তাই নিজের পকেটে টাকা থাকে কোন সাহসে? বড় ভাই প্রতি মাসে গতর খেটে যে ক’টা টাকা পাঠাতেন তা দিয়েই চলতো আমরা ঠুনকো বাহাদুরি। পকেটে পয়সা কম থাকলে জোর করেই সঙ্গী করতাম পয়সাওয়ালা কোনো বন্ধুকে। চলে যেতাম মেহেরচন্ডি স্টেশনে সিস্টেম খাবার খেতে। চবনবাহার দিয়ে পান খয়ে ঠোঁট লাল করে ফিরতাম। তবে পয়সাওয়ালা বন্ধুটিকে সেদিন কোনো ক্রমেই বিল দিতে দিতাম না। কারণ পরের দিনে খাওয়ার জোগাড়টা রাখতে হবে তো! অভাবে বুদ্ধি-ফিকির বলে কথা। টাকার অভাবে এক সিংগাড়ায় দিন পার করা। পেটের ক্ষুধা আড়াল করতে মশকরা করে বান্ধবীর ভ্যানিটি ব্যাগের টিফিন খেয়ে ফেলা। দু’চার টাকা যা থাকতো তাই নিয়ে কাজলার পিটার ভাইয়ের সাইবার ক্যাফেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। বকের মতো ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা। এক রিপোর্টে সাত ঘণ্টা ব্যয় করা। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের পরীক্ষায় পিটারের ফেল মারা। আমাকে আমাকে সাইবার ক্যাফে থেকে বের করে দেওয়া। নিয়মিত পড়াশুনা না করার রেজাল্ট খারাপ করা। সবই শুধু শখের সাংবাদিকতার জন্য।
 
কোনো কোনো সময় খুব হতাশ হতাম। আব্দুল্লাহ আল মামুন, জাহাঙ্গীর হোসেন, হাবিবুর রহমান রাসেল (সবাই ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক) খোঁজ খবর নিতেন মাঝে-মধ্যে। কাজী মামুন হায়দার রানা (গণযোগযোগের শিক্ষক) লালন চর্চা কেন্দ্রে বসে গান ধরতেন। আমি অপেক্ষায় থাকতাম, কখন সিংগাড়ার অর্ডার দেন। লোকটি আমায় খুব ভালোবাসে মন থেকে। এখনও। এভাবে চলতে থাকে সংবাদকর্মীর রিপোর্টার হওয়ার চেষ্টা ।
 
গান আর আড্ডাবাজির মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে যে ক’জন ছাত্র সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে (আমাদের সময়ে) তাদের মধ্যে খোকন-সুজন (আলী আজগর খোকন ও মেহেরুল হাসান সুজন) জুটি মোটামুটি জনপ্রিয়। জোট সরকারের সময় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা অনেকটা দলকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ফলে প্রগতির চর্চা করে এমন বড় একটি শ্রেণী আমতলার সাংবাদিক পরিচয়ে চলতে থাকে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে সবাই মিলে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু একঘরে থাকা হলো না। আগের দুই অংশের সংসার এবার হলো তিন অংশে। প্রকাশিত হলো আমাদের চিত্তের দুর্বলতার। বোঝা গেলো, আমরা ঐক্যে অভ্যস্ত নই। সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি। জায়গা এবার আমতলা আর জামতলা। আমতলায় বাবু-জোহা-শহীদ গ্রুপ। আর জামতলা মানে সিনেট ভবনের পিছনে উজ্জ্বল গ্রুপ। উজ্জ্বল গ্রুপের খাস খাদেম খোকন-সুজন। ভেতরে ভেতরে হিসেব কষতে থাকি আর কি ঐক্য সম্ভব নয়? সুজন একদিন প্রস্তাব করলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রির্পোটার্স ইউনিটি নামে একটি সংগঠন ছিল। এখন কার্যক্রম নেই। সেটিকে জাগিয়ে তুললে কেমন হয়? বললাম, ভালো। খুব ভালো হয়। এরপর গঠিত হয় আহ্বায়ক কমিটি। এলো নির্বাচনের সময়। জুনিয়ররা ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ-ই রাশিদ পলাশ আর সালাহউদ্দিন সুমন আমাকে হল থেকে ডেকে শহীদ মিনারের মাঠে নিয়ে যায়। পলাশের মধ্যে সংবাদকর্মীর তেমন কোনো গুণ ছিল না। পড়তো অ্যাকাউন্টিংয়ে। তবে সংগঠন বুঝতো। সাংগঠনিক ছেলে।

আমাদের এক বছরের সিনিয়র। সে আমাকে বুঝাচ্ছে, ‘দেখ, সুজন অনেক বড় রিপোর্টার (সমকাল)। ওকে আমরা সভাপতি মেনে নিয়েছি। এখন তুই শুধু বাকি। আমরা চাই সুমন আর তুই সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কর। ’ খেলা বুঝে গেলাম।
 
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংবাদকর্মী হিসেবে সালাহউদ্দিন সুমনকে কখনোই পাওয়া যেত না। সে ছিল রাজশাহী প্রেসক্লাবমুখী। কালে-ভদ্রে ক্যাম্পাসে হাজিরা দিতো। সম্পাদক পদে হঠাৎ-ই গেঁজে বসলো। তবে সে লেখনীতে সাহসী। দু’য়েকজন জুনিয়রের মুখ দেখে বুঝে ফেললাম, তাদের ওপর দিয়ে ঝাঁড়-ফুঁকের বাতাস প্রবাহিত হয়েছে। কারও কারও চোখ জলে ছল ছল করছে। মনে মনে বললাম, ‘খোকন, ছাড় দিতে হবে। এখানে দলবাজির অনেক লোক আছে। নীতি, দাবি, অধিকার ভুলে যাও। পলাশের মাথায়ও কাঁঠাল ভাঙা হয়ে গেছে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নামে যেহেতু একটা বিভাগ আছে, এখানকার সাংগঠনিক পরিচয়ও বিভাগীয় শিক্ষার্থীদের হওয়া জরুরি। অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের গান-বাজনা বা অন্য অন্য চাকরি-বাকরি করার সুযোগ আছে। সাংবাদিকতার সুযোগটা তাদের কব্জায় থাকা দরকার। এটা তাদের অধিকার। যেহেতু তারা পড়াশুনাই করছে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য (!)।
 
অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রবেশ তাই বিধি বহির্ভূত। উন্নত ছাড় আর উদারতার পরিচয় দিতে হবে। বললাম, তোরা যখন দু’জনেই আছিস, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়াটা কি খুব দরকার? লেখায়-কথায় সুমনের বিকল্প তো দেখি না। সম্পাদক ও থাকলে তো ভালোই হয়। কথা রখলো পলাশ-সুজন। সুমনকে সম্পাদক বানিয়ে আমাকেও সম্মান দেখালো তারা। বানালো সিনিয়র সহ-সভাপতি।
 
মনে মনে ভাবলাম, সত্যি, ওরাও কত উদার! ওরা কি ছাড় দিলো! আমাকে এত্তোবড় একটা পদে বসিয়ে দিলো! অথচ আমার একটা টাকাও খরচ হলো না! চলতে থাকে দিন। আনন্দে আছি। আমার সভাপতি একনায়কতন্ত্র কায়েম করে চললো। যেহেতু সম্পাদক শহরমুখী। ক্যাম্পাসে তাকে প্রয়োজনেও পাওয়া যায় না। তাই সম্পাদককে ছাড়াই সব কাজ শেষ হতে শুরু হলো। মাঝখানে আমি বড় বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেলাম। দাঁড়ি-কমা হয়ে থাকাটা আর চলে না। ভাবলাম,খোকন এবারও উদারতা দেখাতে হবে। ছাড় দিতে হবে। ছাড় দিলাম। অব্যাহতি নিলাম (পদত্যাগ) রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে।
 
সিনিয়র-জুনিয়র অনেকেই বললেন, এবারও কেন ছাড়? বললাম, কেউ কিছু করতে চাইলে, তাকে তো সুযোগটা দিতে হবে। ছাড় দিয়েছি শখের সাংবাদিকতাকেও।

ক্যাম্পাস ছেড়েছি ২০১১ সালে। হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি জামতলার রিপোর্টাস ইউনিটিকে। আহ! ছাড় দিয়েও তো ওদের জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা হলো না! শেষে ওরা কাদা-জলে মাখামাখি করতে এখন একটা জায়গা পেয়েছে রাকসুতে। আমি কয়েকবার গিয়েছি ওখানে। ওদের আন্তরিকতা, চেষ্টা এবং শ্রম প্রশংসনীয়। ওরা পরিশ্রমী। সংগঠনটির ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ওরা আমাকে দাওয়াত করেছে। শরীরটা ভালো নেই। কিছুটা সুস্থ হলে যাবো ভেবেছি। আমার অনুজ শামীম, তমাল, কায়কোবাদ খুব ভালো লেখে। আমি মনযোগ দিয়ে প্রায়ই ওদের লেখা পড়ি। তাই ওদের নমস্যঃ। যুগ যুগ জিয়োঃ যুগ যুগ লেখঃ।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।