রোহিঙ্গা সংক্রান্ত এ পর্যন্ত প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, আগত শরণার্থীর অধিকাংশই নারী ও শিশু। ফলে আগত এবং অনাগত শিশুদের একটি বিরাট সংখ্যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরগুলোতে উপচে পড়ছে।
৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা গর্ভবতী
রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করে অনেকেই ছিন্নমূল-গৃহহীন শিশুদের আহাজারির কথা জানিয়েছেন। শুনেছেন নবজাতকের কান্নার শব্দ। সন্তান-সম্ভবা গৃহত্যাগী নারীদের কষ্টকর জীবনের বিবরণও প্রকাশ পেয়েছে। মানবিক বিপন্নতার চরম চিত্রটি উন্মোচিত হয়েছে নারী ও শিশুদের অমানবিক পরিস্থিতির বাস্তবতার নিরিখেই।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সর্বত্রই শরণার্থী আশ্রয় শিবিরগুলোতে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হয় নারী ও শিশুরা। গর্ভপূর্ব, গর্ভকালীন ও গর্ভপরবর্তী সময়ে একজন মায়ের যে স্বাভাবিক যত্ন ও খাদ্য দরকার, তা রিফিইজি ক্যাম্পের সীমিত সুবিধার পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কখনোই আশা করা যায় না। তার বিশ্রাম, সন্তান পালন, দুগ্ধদান ইত্যাদির কোনো বালাই থাকে না লক্ষ লক্ষ মানুষের আতঙ্কিত-পদচারণায় ভারাক্রান্ত উদ্বাস্তু শিবিরের প্রায়-বন্দিদশায়। অন্যদিকে, নবাগত ও অন্য শিশুর জন্য যে মানের খাদ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার আবশ্যকতা রয়েছে, তাও শরণার্থী শিবিরের অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ পরিবেশে কল্পনা করা যায় না। ফলে মানবসমাজের প্রান্তিক ও ভঙ্গুর অংশ হিসাবে যে কোনো সংঘাত ও সংঘর্ষে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় নারী ও শিশুরা। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার বেলায়ও এই সত্যটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘাত ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সংস্থাগুলো নারী ও শিশুদের বিপন্নতার বহু প্রমাণ তুলে ধরেছেন। লেবাননের ক্যাম্পগুলোতে বোমার আঘাতে সবচেয়ে বেশি আহত-নিহত হয়েছে নারী ও শিশু। সিরিয়া-ইরাকের আন্তঃসংঘাতে শিশু ও নারী নির্যাতনের চরম ও নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আফগানিস্তানে শিশুরা পরিস্থিতিগত কারণে শিশুর মতো বড় হয় নি, বেড়ে উঠেছে ট্যাঙ্ক বা কামানে চড়ে কিংবা কালাশনিকভ রাইফেল চালিয়ে। ফলে সংঘাত শুধু মানবিকতাকেই হত্যা করে নি, অনাগতকালের মানবপ্রজন্ম তথা শিশুদের স্বপ্নময় সত্তাকেও হনন করেছে এবং স্বপ্ন ও আনন্দের বদলে শিশুদের ভীতি আর সন্ত্রাসের উপজীব্যে পরিণত করেছে। যুদ্ধ আর রক্তের মাঝ দিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শরণার্থী শিশু আর স্বাভাবিক মানুষ হয় নি; হয়ে গেছে সন্ত্রাসের, যুদ্ধের, জঙ্গিবাদের উপকরণ।
বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে অবস্থিত মিয়ানমার থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শিশুর ভবিষ্যত কার্যতই অনিশ্চিত। আগামী দিনগুলো তাদের কোন দিকে যাবে কেউ জানে না। তাই মোট শরণার্থীর শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ নারী ও শিশুর ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তার কথা সকল শরণার্থীর চেয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার এবং তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পরিচর্যার বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় এখনও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়েছে বলা যাবে না। তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আপদকালীন সময়ে আশ্রয় শিবিরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে বিশ্বকে একযোগে কাজ করতেই হবে। নইলে মিয়ানমানের গণহত্যায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মতোই রোগে-শোকে-অনাহারে-অযত্নে আরো হাজার হাজার নারী ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকিকে এড়ানো সম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যেই মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের তালিকায় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। সভ্য ও আধুনিক জগতে এমন বর্বর নিপীড়ন অকল্পনীয় হলেও সেটিই অকাতরে ও অবিরামভাবে ঘটছে। আগুনে পুড়ছে বাড়ি-ঘর, বুলেটে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, ধর্ষিতা হচ্ছে নারী, পচে-গলে-ভেসে উঠছে শিশুদের নিথর মরদেহ। আগাম সতর্কতা ও উদ্যোগের অভাবে যদি শরণার্থী শিবিরগুলোতেও নারী আর শিশুরা রোগে-শোকে-অবহেলায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাতে থাকে, তাহলে ইতিহাস পৃথিবীর মানুষদের ক্ষমা করবে না।
আজ থেকে ৭০ বছর আগে মাত্র একুশ বছরে মারা যাওয়া কিশোর-কবি সুকান্ত ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থে বলেছিলেন, ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে/ তার মুখে খবর পেলুম/ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক/ নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার/ জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে। ’
গৃহছাড়া-পিতৃহারা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শিশু সীমান্তবর্তী শরণার্থী আশ্রয় শিবিরের তৃণময় মাটিতে শুয়ে উপরের খোলা আকাশের দিকে সুতীব্র চিৎকারে যে মৌলিক-মানবিক অধিকার ব্যক্ত করছে, বিশ্ব বিবেক কি তা শুনতে পাচ্ছে?
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৭
ওএইচ/জেডএম