ব্লু হোয়েল সংক্রান্ত খবারাখবর মিডিয়ায় আসার আগে সাইবার জগতে ফেসবুক, চ্যাট ইত্যাদি আসক্তির প্রচলন ছিল কোনও কোনও তরুণ-তরুণীর মধ্যে। এসব প্রবণতা বিষণ্নতা ও হতাশার কারণ হলেও প্রাণঘাতী ছিল না।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘আসক্তি’ নামক সমস্যাটি সম্পর্কেও নতুন করে ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত ঘটানোর দরকার পড়ছে। আগে নানা ধরনের মাদকদ্রব্যকেই আসক্তির একমাত্র কারণ মনে করা হলেও এখন আসক্তি হাতের মোবাইল আর টেবিলের কম্পিউটারে পৌঁছে গেছে। বাস্তব আর সাইবার জগতের মিলিত আসক্তি অক্টোপাসের মতো শত হাতে গলা টিপে ধরছে মানুষের। এই ঘোরতর বিপদে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা।
আসক্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখতে পেলাম এক ভয়াবহ তথ্য। ইউরোপীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের মতে, বছরে মোট ৬৭টি নতুন মাদকদ্রব্য আবিস্কৃত হয় পৃথিবীর নানা প্রান্তে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে একটিরও বেশি নতুন পণ্যের সরবরাহ পেয়েছে আসক্তরা। বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণার তথ্যানুযায়ী দেশে পুরনো ও নতুন মিলিয়ে তিন ডজনেরও বেশি মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে, যেগুলো হর-হামেলা নেশাগ্রস্তরা ব্যবহার করছে।
বলাই বাহুল্য, মদ, তাড়ি, পাঁচুই, গাঁজার দিন শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এসেছে নতুন নতুন কেমিক্যাল ও নন-কেমিক্যাল ড্রাগস। আসক্তরা একটা ছেড়ে আরেকটা ধরছে। গাড়ি বা ফোনের মডেল চেঞ্জের মতো নিত্য নতুন মাদ্রকদ্রব্য ভোক্তাদের আগ্রহী করছে। বিস্তৃত হচ্ছে নেশার জগত আর নেশাসক্তের সংখ্যা। ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের জন্যও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন বিপদ।
গতানুগতিক আসক্তি সংক্রান্ত সমস্যার গবেষণা ও চিকিৎসায় সাইবার জগতের আসক্তিকে বিবেচনায় ধরা হয় নি। ব্লু হোয়েল’র আবির্ভাবের পর পরিস্থিতি নিশ্চয় আগের মতো থাকছে না। সবাইকেই নতুন করে সতর্ক হতে হচ্ছে। বাস্তবের মাদ্রকদ্রব্য আর সাইবার এডিকশনকে সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হচ্ছে। সমস্যা হিসেবে বাস্তব আর সাইবারের ক্ষেত্র থেকে আসক্তিজনিত ক্ষতির দিকগুলোও খতিয়ে দেখার দরকার পড়বে।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের দফতর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও লোকবল নিয়ে সমস্যাটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা চলছে। প্রয়োজনে আক্রান্তদের চিকিৎসারও নানা রকম ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানের নতুন ধরনের আসক্তির ব্যাপারে কি করা দরকার, সেটাও খুঁজে বের করা জরুরি।
উল্লেখ্য, সাইবার বা ভিজুয়্যাল আসক্তি আগেও বাংলাদেশে হানা দিয়েছিল। অবশ্য সেটা এসেছিল অন্যভাবে। আশির দশকে টিভি সিরিয়াল ম্যাকগাইভার ছবি দেখে উৎসাহিত হয়ে দালান থেকে লাফ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। টারজান বা স্পাইডারম্যান সাজতে গিয়েও আহত-নিহত হয়েছিল কেউ কেউ। শিশু ও তরুণ মনের অনুকরণ প্রবণতা ও এডভেঞ্চারের শখ যুক্তি দিয়ে থামাতে না পারলে বিপদ আসবেই।
ফলে সর্বসাম্প্রতিক সময়ে সাইবার জগত থেকে উদ্ভুত আসক্তি মোকাবেলার কিরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে, তা ভেবে দেখতে হবে। কম্পিউটার গেমস, অ্যাপস এবং ইন্টারনেটের নানা সূত্র থেকে যেভাবে আসক্তি ছড়াচ্ছে এবং ভয়ঙ্কর সব চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহারকারীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিরোধের কি ব্যবস্থা আমাদের হাতে রয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখার দরকার আছে। বিপদ তীব্রতর হয়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ার আগেই যদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। তাই সম্ভাব্য বিপদের আগেই বিপদ সম্পর্কে সতর্কতামূলক প্রস্তুতির দিকে সংশ্লিষ্ট সকলকেই অতিদ্রুত মনোযোগী হতে হবে। আর সংশ্লিষ্ট বলতে কেবল সরকারই নয়, সামাজিক নানা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ এবং অবশ্যই অভিভাবকদের গণ্য করতে হবে। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে থাকলে বিপদ কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের কাছে বিপদ চলে আসতে পারে। অতএব, সমস্যাটি সম্পর্কে সকলকেই জরুরি ভিত্তিতে ভাবনা-চিন্তা করে পদক্ষেপ নিতে হবে, এ ক্ষেত্রে বিলম্ব মোটেও বাঞ্ছনীয় হবে না।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৭
বিএস