মারামারি, হামলা-মামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া তো দূরের কথা, কোনো হই-হুল্লোড়ই নেই। যে যার মতো কেন্দ্রে গিয়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে চলে যাচ্ছেন।
১৬ কোটি মানুষের দেশ জাপানে এ নির্বাচনে কোথাও ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটেনি। এমন শান্তির নির্বাচন আর কখনো দেখিনি। সত্যি, শান্তির দেশে নীরব ব্যালট বিপ্লব ঘটছে আজ।
ভোটকেন্দ্রগুলোতে নেই কোন পোস্টার বা ব্যানার। নেই বাড়তি কোন লোকের সমাগম। অনেক উৎসাহ নিয়ে সকালেই ঝড় আর ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে প্রথমেই বেশ কনফিউজড হয়েছিলাম। এসব ভোটকেন্দ্র না অন্যকিছু! পরে দেখলাম যে যার মতো নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসে ভোট দিয়েই চলে যাচ্ছে। কেউ ভোট দেয়া শেষে ৩০ সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। কি আজব দেশ!
সকালে টোকিও থেকে প্রায় ২শ’ কিলোমিটার দূরে ইয়ামানাসির কিতাশো গাক্কো ভোটকেন্দ্র সর্বপ্রথম পরিদর্শন করি। এখানে কিতাশো স্কুলটি থেকে ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মায়োমি মিহারা নামে ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। ভোটের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে বলেন, ভোট দিয়েছি। এখন বাসায় যাচ্ছি।
ইশাওয়া অনসেনের একটি ভোটকেন্দ্রে সকাল ১১টায় গিয়ে দেখি, দু-একটি গাড়ি ঢুকছে বা বের হচ্ছে। ভেতরে একজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম, এখানেও যে যার মতো ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছে।
জাপানের সংসদের নিম্নকক্ষে ৪৬৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৮৯ জন আইনপ্রণেতা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। বাকি ১৭৬ জন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবেন। ক্ষমতায় যেতে হলে অন্তত ২৩৩টি আসন পেতে হবে।
জাতীয় এই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করছে মূলত তিন জোট। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) সমর্থিত জোট এবং টোকিও সিটির প্রথম নারী গভর্নর ইউরিকো কোইকে’র নেতৃত্বাধীন আলোচিত নতুন দল কিবো নো তো (পার্টি অব হোপ) এর সঙ্গে। নতুন এ দলটিকেও সমর্থন দিচ্ছে বেশ কয়েকটি ছোট দল। পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিপি) নেতৃত্বাধীন জোটও লড়াইয়ে আছে। তবে সর্বশেষ জনমত জড়িপে শিনজো আবের দল এগিয়ে রয়েছে বলে দেশটির প্রধান গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। সর্বশেষ জনমত জরিপে শিনজো আবের দল তিনশতাধিক আসন পাবে বলে আভাস দিয়েছে। তবে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন আলোচিত নারী প্রার্থী ইউরিকো কোইকে।
এবারের নির্বাচনে উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকি মোকাবিলা ও ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ব অলিম্পিক আসর ও দব্যের ট্যাক্স বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু বিষয় মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাপানের পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে শিনজো আবে আগাম নির্বাচন ঘোষণা করেন। নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে বিদ্যমান সংকটে জনমত জানতে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই সাধারণ নির্বাচন দেন শিনজো আবে।
এর আগে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিনজো আবে। তার দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ডায়েটে (জাপানের পার্লামেন্ট) জোট সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে শিনজো আবের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তবে জাপানের ওপর দিয়ে উত্তর কোরিয়ার দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর শক্ত অবস্থান নেওয়ায় আবের প্রতি জনসমর্থন আবারও বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আবের এই আগাম নির্বাচন ঘোষণায় বিশ্লেষকরা বলছেন, বেড়ে যাওয়া জনসমর্থন ও বিরোধী দলের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছেন শিনজো আবে। জুলাইয়ে আবের জনসমর্থন ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
জাপানে সংসদীয় রাজতন্ত্র, অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় সম্রাটের ক্ষমতা মূলত আনুষ্ঠানিক ও সীমিত। অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রের মত জাপানেও সরকার ব্যবস্থা তিন ভাগে বিভক্ত। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী জাপান সরকার পরিচালিত হয়। এটি একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র যার প্রশাসনিক অঞ্চল ৪৭টি এবং সম্রাট হচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান। তবে সম্রাটের ক্ষমতা প্রকৃত নয়, আনুষ্ঠানিক। সরকার চালানোর প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অধীনস্থ রাষ্ট্রমন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত ক্যাবিনেটের হাতে অর্পিত। ক্যাবিনেট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে জাতীয় সংসদ বা ডায়েট, এবং তাঁকে তাঁর পদে নিয়োগ করেন সম্রাট। জাতীয় ডায়েট হলো আইন বিভাগের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক। এটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, যেখানে উচ্চকক্ষটি হল উপদেষ্টা পরিষদ এবং নিম্নকক্ষ জনপ্রনিধি পরিষদ। নিম্নকক্ষের সদস্যরা জনসাধারণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন।
মাহবুব মাসুম: প্রবাসী সাংবাদিক, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৭
জেডএম/