কিভাবে ইউনেস্কো’র স্বীকৃতির মাধ্যমে এই ভাষণ আন্তর্জাতিক ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে’ জায়গা করে নিয়েছে- এর নেপথ্যের দীর্ঘ প্রক্রিয়াসহ অজানা অনেক তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে সরকার কোরিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলামকে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কো’য় স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করে।
এই তালিকায় আগে শুধু পাণ্ডুলিপিকে বিবেচনা করা হতো। ৭ই মার্চের ভাষণ লিখিত না হওয়া কিংবা পাণ্ডুলিপি না থাকায় শুরুতে ইউনেস্কোয় জমাদানের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। পরে সংস্থাটি ডিজিটাল ডকুমেন্টকেও প্রামান্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। এতে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের অডিও ভিজ্যুয়াল দলিল জমাদানের বাধা দূর হয়।
জানা গেছে, এ পর্যায়ে ভাষণটি জমা দানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ফ্রান্স থেকে ঢাকায় মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের সচিব মনজুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের পর তথ্য মেলে মুখ্যসচিব ২০১৩ সালে শিক্ষাসচিব থাকাকালে তাঁর অনুমোদনক্রমে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক কম্বোডিয়ার একটি কর্মশালায় উপস্থাপনের জন্য ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর কাজ করেছেন। তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করা হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। ইউনেস্কোর প্রামাণ্য ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড অনুসারে উপাত্তে আরও কিছু বিষয় যোগ করার প্রয়োজন হলে শুরু হয় ঢাকায় যোগাযোগ।
জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ এর মহাসচিব মোনায়েম সরকার, ডিএফপি মহাপরিচালক লিয়াকত আলী খান, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক একেএম নেসার উদ্দিন ভূইয়া, ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন, বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কিউরেটর এন আই খান, ইউনেস্কা মহাসচিব সোহরাব হোসেন, বিটিআরসি’র সচিব সারওয়ার আলম প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করে ঐতিহাসিক ভাষণের প্রামাণ্য দলিলাদি সংগ্রহ করেন। সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যৌথ ক্রেডিটলাইনে ভাষণের প্রামাণ্য দলিলাদি ইউনেস্কোয় জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ইউনেস্কোয় জমা দেয়া নথিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রকাশ ও সম্প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। এরপরও তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সাহসী কর্মীগণ, পূর্ব পাকিস্তানের ফিল্ম ডিভিশন এবং দেশি বিদেশি সাংবাদিকগণ তা ধারণ, প্রকাশ ও সম্প্রচারের উদ্যোগ নেন। ইউনেস্কোর নির্ধারিত ফরম্যাটে প্রদত্ত বিস্তারিত নথি থেকে বেরিয়ে এসেছে এই ভাষণ ধারণ, সম্প্রচার, সংরক্ষণ ও তথ্য উপাত্তের নানা দিক। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ থাকার পরও তখনকার প্রোগ্রাম অর্গানাইজার নেসার আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণাঙ্গ অডিও রেকর্ডিং করেন। আনকাট রেকর্ডিংটির দৈর্ঘ্য ১৯ মিনিট। এটি ৭ মার্চ রেডি্ওতে সম্প্রচার করতে দেয়নি সামরিক জান্তা।
রেডিওর বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুমুল দাবি ও রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা স্টেশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সম্প্রচার করতে দেয়া হয় পরদিন ৮ মার্চ। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে অডিও রেকর্ডিংয়ের দুটি কপি গোপনে নবগঠিত স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জানা গেছে, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এম এ খায়ের এর মালিকানাধীন ‘ঢাকা রেকর্ড’ কোম্পানি এর একটি ৪৫ আরপিএম রেকর্ড করেছিল। এই রেকর্ডটি সম্পাদনা করায় তার দৈর্ঘ্য কমে হয় ১৫ মিনিট। ১৯৯৬ সালে রেকর্ডটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করা হয়। সেখানে তা সংরক্ষিত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ক্যামেরাম্যান এম এ মবিন এর সহায়তায় এই ভাষণের অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডটি ধারণ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ফিল্মস ডিভিশনের প্রধান মহিবুর রহমান খয়ের। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর পূর্ণাঙ্গ ভাষণটির অডিও ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। ২০১৩ সালে ফিল্মস আর্কাইভ অধিদফতর এর ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ করে এবং ২০১৪ সালে তথ্য্ ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ভাষণটির উন্নত রঙিন সংস্করণ প্রকাশ করে।
একান্ত সাক্ষাৎকারে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত এম শহিদুল ইসলাম জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত থাকতে পেরে আমি গর্বিত। এটি জমা দেয়ার জন্য ফ্রান্সে দায়িত্ব পালনকালে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকায় সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার ফলেই ইউনেস্কোর মানদণ্ড অনুযায়ী এর অথেনটিসিটি, ইনট্রিগ্রিটি এবং আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখপূর্ব্বক পূর্ণাঙ্গ নথি জমা দেয়া সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ একটি স্বাধীন দেশ অভ্যুদয়ের অনুপ্রেরণাদায়িই শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রাসঙ্গিক ও শিক্ষামূলক। এই স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও গৌরব যথেষ্ট বেড়েছে বলে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের গরীব বলে মনে করা হয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে আমরা ধনী। তাই কালচারাল দূতিয়ালির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৭
জেডএম/