ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এই আদিম বর্বরতার শেষ কোথায়?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
এই আদিম বর্বরতার শেষ কোথায়? ফাইল ফটো।

ঘটনাটি শুনে মনে হবে, আদিম সমাজের কিছু জংলি মানুষের কাণ্ড। কিংবা প্রাচীন ও অন্ধকার আফ্রিকার হিংস্র জাতিগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদ গোত্রীয় বর্বর তৎপরতা। কিন্তু আসলে তেমন নয়। ঘটনাটি বাংলাদেশেরই। চলমান একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান-শিক্ষা-প্রযুক্তি ও প্রগতির তীব্র সময়েই ঘটেছে। দুই দল মানুষ প্রকাশ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করেছে।

সংঘবদ্ধ যুদ্ধের মতো প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আহত করেছে অবলীলাক্রমে।

এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের একজনকেও পাওয়া গেল না, যিনি উন্মত্ত জনতাকে থামানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। না সমাজ, না প্রশাসন, কেউই না। চোখের সামনে পাঁচ জন মানুষ নিহত হলেন। ৩০/৪০ জন আহত হলেন। শত শত লোক লড়াই করলো বন্য ও আদিম হিংস্রতায়।

গত বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের চারিগ্রাম নামক স্থানে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। এক) মানবিকতা ও সামাজিকতার স্তরের দিক থেকে আমরা কোথায় আছি যে, আদিম গোত্রের মতো দিনে-দুপুরে হানাহানি করে হত্যাকাণ্ড করছি? এবং দুই) আইন ও প্রশাসন এই দীর্ঘ সংঘাতের সময় কোথায় ছিল? রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে এমন একটি নৃশংসতা ঘটলো, তবু সেটা প্রতিহত করা হলো না কেন?

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও ক্ষমতা কাঠামোয় এখনও আইন ও শৃঙ্খলার বিকাশ সেভাবে ঘটে নি, এই বর্বরতা সেটার প্রমাণবহ। প্রত্যন্ত হাওরে, চরাঞ্চলে, দ্বীপে বিভিন্ন সুযোগ ও সম্পদ এবং ক্ষমতার জন্য এমন লড়াই প্রায়ই হচ্ছে। দেশীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার নিয়ে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, অঞ্চলে অঞ্চলে দাঙ্গারূপী লড়াই হচ্ছে। কখনো হয়ত এ পাড়ার কেউ ও পাড়ার কাউকে মেরেছে কিংবা এর মুরগী ওর ক্ষেতের ধান খেয়েছে, তাতেই সংঘবদ্ধভাবে রক্তাক্ত লড়াই শুরু হয়ে যাচ্ছে। অকাতরে মানুষ আহত, নিহত হচ্ছে।

ফাইল ফটো প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক নেতৃত্ব তখন কোথায় থাকে? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত থামানোর কোনও ব্যবস্থাও কি তখন থাকে না? নাকি সবাই পেছন থেকে এসব উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে হাওয়া দিয়ে ফায়দা লুটার তালে থাকে? নইলে এই মোবাইল, ইন্টারনেটের যুগে একটি এলাকায় শত শত লোক লড়াই করবে, এ খবরটি পুলিশ, প্রশাসন, চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে যেতে তো কয়েক মিনিট সময়ও লাগার কথা নয়! এতোসব সামাজিক সংযোগ ও যোগাযোগের সময়ে কোথাও উত্তেজনা দানা বাঁধছে, সেটাও তো আগে-ভাগে জেনে যাওয়ার কথা!

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দায়িত্বশীলরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কেউ যেন কিছুই জানে না। জানতে চায় না। বর্বর লড়াই চলার সুযোগ দেয়। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবাই সক্রিয় হয়। শত শত মানুষকে আসামি করে পাল্টা-পাল্টি মামলা হয়। উভয় পক্ষের পুরুষরা হয় জেলে যায়, নয় তো মামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায়। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা দিন কাটায় চরম নিরাপত্তাহীনতায়।

হাসপাতালের মর্গে চাটাই দিয়ে মোড়ানো সারি সারি লাশ ঘিরে চলে পরিবারের ক্রন্দন। জেলখানা, থানা, পুলিশ, কোর্ট, কাচারিতে আটক পুরুষদের বাঁচাতে তদবিরে নেমে পরিবারের নারী সদস্যরা ঘাটে ঘাটে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়। আর্থিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত দিক থেকে একজন বা দুইজন নয়, অসংখ্য পরিবারের শত শত মানুষ বিপণ্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সংঘাতে প্রাণহানির ক্ষতি টানতে গিয়ে আরো বহু মানুষ বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে।

গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে শহরেও এমন সংঘবদ্ধ শক্তির মহড়া সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সভ্য সমাজ ও আইনের শাসনের দাবি করা তখন কিভাবে সম্ভব হয়? প্রায়ই যে গ্রাম, শহরে, এমন কি রাস্তায়, কোনও সমস্যা হলেই আলাপ-আলোচনার বদলে মারপিট ও সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও করা হচ্ছে, তা কিসের আলামত? সব সময় যে বিরোধী পক্ষই এসব করছে, তথ্য তেমন বলে না। ক্ষমতার ভাগীদাররাও নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিয়ে চরম অরাজকতার সৃষ্টি করছে। এতে সমাজের শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার বারোটা বেজে যাচ্ছে। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে কে লাভবান হচ্ছে?

ফাইল ফটোনিশ্চয় সাধারণ মানুষ এসব ঘটনায় উপকৃত হয় না। উপকৃত হয় মাফিয়া ও দুর্বৃত্তরা। এদের হাতে সকল কিছু চলে গেলে সুশাসনের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা এই অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে আরও প্রলম্বিত ও অসহনীয় করছে। এসব ঘটনা মানুষের মধ্যে শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা বাড়াচ্ছে। মানুষ উগ্র ও সশস্ত্র হয়ে একে অপরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আইন ও নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। আইন, প্রশাসন ও রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে এই শক্তিমত্ত গোষ্ঠীর অধীনস্থ।

শক্তির চর্চা ও শক্তির পূজা করার কুফল সমাজের নানা স্থানে প্রতিনিয়তই একটি-দুইটি করে দেখা যাচ্ছে।

এই কুপ্রবণতা ক্রমে ক্রমেই বাড়ছে। কিছু হলেই আইন হাতে তুলে মারপিট বা রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে জ্বালাও-পোড়াও করা হচ্ছে। এই অনিয়মকে আইনের আওতায় আনার বদলে পিঠে হাত বুলিয়ে ঠাণ্ডা করতে হচ্ছে।

ছাড় দেওয়া হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। এসব খারাপ উদাহরণ সমাজ ও মানুষের মধ্যে শক্তিচর্চার মানসিকতা বাড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। ক্রমশই যেন সবাই এই বলদর্পী গোষ্ঠীর কাছেই জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। কেউই জানে না, এই আদিম বর্বরতার শেষ কোথায়?

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।