রাজীবের মৃত্যুর পর অন্তরালে তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীই কংগ্রেসের হাল ধরেন। পালে যদিও তখন নরসীমা রাও।
ইতালির নিভৃত গ্রাম ভিসেনজা, সেখান থেকে ক্যামব্রিজ ও রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্ক। অতঃপর, প্রধানমন্ত্রী-শাশুড়ির সংসারে নববধূ সোনিয়া থেকে আজকের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী হয়ে ওঠার পথটি সহজ ছিল না। নানা জটিল রাজনীতি, কূটনীতি, দেশীয় সংস্কার-অনুশাসন ও সংকীর্ণতার অন্তর্জাল ভেদ করে তিলে-তিলে বেড়ে ওঠা আজকের সোনিয়া এক বিস্ময়! যদিও সব রাজনৈতিক চরিত্রের সমসাময়িক মূল্যায়ন ইতিহাসে স্থান নাও পেতে পারে। সে কারণেই হয়তো সোনিয়ার ঐতিহাসিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যেমনটি আজ ইন্দিরা গান্ধীর মূল্যায়ন হচ্ছে।
রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পথে সাদা চামড়ার সোনিয়ার জন্য সাদা কাপড়ের পাশাপাশি বিদেশিনীর তকমা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যা প্রায় এক দশক তার পিছু ছাড়েনি। ২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার গঠন করার পর সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে সোনিয়া গান্ধীরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু দলের ভেতরে ও বাইরে বিরোধিতার মুখোমুখি হন তিনি। শারদ পাওয়ারসহ কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত তিনজন জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রশ্ন করেন, একজন বিদেশিনি কীভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন?
সাদা আমেরিকায় কালো রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, কালো আফ্রিকায় সাদা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, কিন্তু শংকর ভারতবাসী শ্বেতাঙ্গ সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করার সুযোগটি নিতে পারেনি। যদিও সোনিয়া এর জন্য আগেই প্রস্তুত ছিলেন।
সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর মতো প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী যেমন এখনো কেউ হননি, তেমনি সোনিয়ার মতো কংগ্রেস নেত্রীও ভারতবাসী পায়নি। ইন্দিরা তার দীর্ঘ কংগ্রেস নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীত্বে একটিই ‘ভুল’ করেছিলেন; তা হলো জরুরি অবস্থা জারি; যা আজও ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু সোনিয়া এখানে অনন্য। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেছেন। ভারত থেকে যা নিয়েছেন, দিয়েছেন তারচেয়ে অনেক বেশি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত না হয়েও ভারতকে যে দু’জন মানুষ সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন তাদের একজন মাদার তেরেসা, আরেকজন সোনিয়া গান্ধী।
তাদের অবদান বলতে গেলে কোনো ভারতীয়ের চেয়েই কম নয়। যদিও সোনিয়ার সময়েই কংগ্রেস সবচয়ে বড় পরাজয়ের শিকার হয়। কিন্তু ১৩২ বছরের পুরনো একটি দলের জীবনরেখায় এটি বড় বিষয় নয়। ইতিহাসের পথ রেখায়ই কংগ্রেস আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ, মনে রাখতে হবে কংগ্রেসের চির-পরাজয় মানে ভারতের পরাজয়। অসাম্প্রদায়িক ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভারতকে কংগ্রেসই ধারণ করে।
সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা চেয়েছিলেন মানেকা কংগ্রেসের হাল ধরুক। কিন্তু মানেকা বলেছিলন, আমি রাজনীতির লোক নই। মায়ের ইচ্ছায় অতঃপর রাজীবের রাজনীতিতে আগমন। সোনিয়া শাশুড়ি ও স্বামীর মৃত্যুর আগেই স্বামীর রাজনীতির বিরোধী থাকলেও কখনোই বলেননি, আমি রাজনীতির লোক নই। হয়তো সোনিয়ার নিয়তিই তাকে রাজনীতির মানুষ বানিয়েছে, হোক তা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর পাইলট যদি রাজনীতির হাল ধরতে পারেন, তবে ক্যামব্রিজওয়ালা কেন পারবেন না?
কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারের অভিষেক হয় ১৯১৯ সালে মতিলাল নেহেরুর মাধ্যমে। এর এক দশক পর সভাপতি হন ছেলে জওহরলাল নেহেরু, যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ১৯৫৯ সালে ও ২০ বছর পরে আবার সভাপতি হন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা নিহত হওয়ার পর রাজীব গান্ধী এবং ১৯৯১ সালে রাজীব নিহত হওয়ার পর শুরু হয় কংগ্রসের সোনিয়া অধ্যায়।
সোনিয়া কংগ্রেসের হাল ধরেছেন, প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন, কিন্তু নিজে হননি, ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম একজন নারীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হতে যাচ্ছেন রাজীব-সোনিয়ার ছেলে রাহুল গান্ধী। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আসছে ডিসেম্বরেই রাহুল হাল ধরবেন কংগ্রেসের। এর মাধ্যমে শেষ হবে কংগ্রেসের দুই দশকের সোনিয়া অধ্যায়। মতিলালের উত্তরাধিকার রাহুল এক্ষেত্রে কতোটা সফল হবেন তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ভারতকে ইতালির ভিসেনজা গ্রামের ওই মেয়েটি কতোটা ভালোবেসেছেন তা তার একটি উক্তি থেকেই অনুমেয়: “Although born in a foreign land, I chose India as my country and would remain an Indian till my last breath. India is my motherland, dearer to me than my own life.”
বিদেশিনী বিতর্কে তিনি কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের সেই পদত্যাগপত্রের কথাগুলো আজও স্মরণীয়। তার ভাষায়, ‘গত ছয় বছরে রাজনীতিতে থাকার মধ্য দিয়ে আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রীর পদ আমার লক্ষ্য নয়; আমি অনেকবার সে কথাটি বলেছিও। ক্ষমতা আমাকে কখনো আকৃষ্ট করে না বা সেটি আমার লক্ষ্যও নয়। আমি সব সময় এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। আজ আমি অন্তরাত্মার ডাক শুনতে পেয়েছি এবং বিনয়ের সঙ্গে এই পদ নিতে অস্বীকার করছি। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিন; এটি আমার অন্তরাত্মার ডাক, আমার চেতনার প্রকাশ। আমার সব সময় উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত এবং দেশের গরিবদের সুরক্ষা দেওয়া। ’
একটি অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত ভারতের যে ‘চেতনা’ সোনিয়া ধারণ করেছিলেন, ভারতবাসী কি সোনিয়ার সেই অন্তরাত্মার ডাক শুনতে পাবে?
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৭
এএ