দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক জনপদ বাংলা ঐতিহাসিকভাবেই ছিল অবহেলিত। কৃষিভিত্তিক বাংলা মুঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানিদের শক্তি ও সম্পদ দিতে দিতে নিজে হয়েছে দুর্বল।
ইংরেজ চলে গেলেও বাংলার অধীনতা আর কাটে নি। বঞ্চনা আর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। এমনই এক সন্ধিক্ষণে উত্থান ঘটে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহান নেতার। শ্যামলিম বাংলার উর্বর ভূমি ও সমাজ থেকে রূপকথার মহানায়কের মতো উঠে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে চারণের মতো সারা বাংলা চষে তিনি শোষিত-বঞ্চিত জনতাকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। জীবনের স্বর্ণালী সময়ের প্রায়-পুরোটাই তিনি কাটান জেলের অভ্যন্তরে। জাতির মুক্তির বার্তা বহন করতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনে সীমাহীন কষ্ট ও নির্যাতনকে সাহসের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন।
বছরের পর পর আন্দোলন ও সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু লাভ করেন সারা বাংলার নির্বাচনী ম্যান্ডেট। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক চক্র বাঙালির অধিকারকে নিয়ে শুরু করে ছিনিমিনি খেলা। ন্যায্য অধিকার থেকে বাঙালি জাতিকে বঞ্চিত করার জন্য শাসকচক্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মুখে রুখে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। ৭ই মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী ময়দানে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ভাষণে তিনি বাংলার মুক্তি ও অধিকারের সনদ ঘোষণা করেন। বাংলার স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছড়িয়ে ছিল তাঁর ভাষণের ছত্রে ছত্রে। আর ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্মোহনী প্রণোদনা।
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে জাগরণী সঙ্গীতের মতো অমরত্ব লাভকারী ভাষণ ৭ মার্চ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক মহাকাব্যের মতো এই ভাষণের ছত্রে ছত্রে প্রস্ফুটিত হয়েছিল জাতির আশা-আকাঙ্খা। মনে হচ্ছিল, নেতার কণ্ঠ দিয়ে কথা বলছে সমগ্র জাতি। কথা বলছে বাংলার দুখিনী মা, সাহসী কৃষক, সংগ্রামী শ্রমিক, উতপ্ত শোণিতের যুবক। কথা বলেছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। বাংলাদেশের সাগর, পাহাড়, মিথিলা। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কথা বলছে সমগ্র বাংলাদেশ।
কি ছিল সেই ভাষণে? ছিল জাতির কণ্ঠস্বর। প্রত্যাশা। স্বপ্ন ও অধিকারের পদাবলী। কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। ছিল জনগণের আত্মার-স্পন্দন-ছোঁয়া কথামালা। জীবনের পুরোটা সময় বাঙালির সুখে-দুখে একাকার হয়ে বঙ্গবন্ধু ধ্বনিত করেছিলেন তাদেরই মর্মবেদনার কথা, মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার কথা
ভাষণটি সংক্ষিপ্ত ছিল। ছিল বাহুল্য বর্জিত। ছিল স্পষ্ট। সাহসী। তেজোদীপ্ত। শত্রুর বিরুদ্ধে ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রত্যয় ও প্রতীতিতে ভরপুর। রাজনৈতিকভাবে দূরদৃষ্টিপূর্ণ। আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকতার অক্ষরে পরিপূর্ণ, কিন্তু বিদ্রোহের সুপ্ত জ্বালামুখ। অগ্নিশিখার মতো ভাষণের প্রতিটি শব্দ বাঙালির আত্মা ও শরীরে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল। অগ্নিগর্ভ জাতি পেয়েছিল মুক্তির দিশা। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ লিপিবদ্ধ হয়েছিল ৭ই মার্চের ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় সমগ্র দেশ আনন্দে উদ্বেলিত। সমগ্র জাতি বাঁধ-ভাঙা উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত। বাংলাদেশ যেন ৭ মার্চের ভাষণের সুরে একাকার হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে ঘোষণা করছে ‘জয় বাংলা’। সমগ্র জাতি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উত্তোলিত করে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে বলছে ‘জয় বাংলা’। ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ ও বাঙালির ঐক্য ও শক্তির সমুজ্জ্বল প্রতীক; বিজয়ীর দৃপ্ত পদভারে আগামীর পথচলার অনিঃশেষ প্রেরণা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৭
এমপি/জেডএম