অর্থনীতির পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রেও জনসংখ্যা রফতানির অভাবনীয় অবদান রয়েছে। বহু বেকার এভাবেই দেশের বাইরে গিয়ে পয়সার মুখ দেখছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে, যা এ খাতের অর্জন। রেমিটেন্সে মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিটেন্স, এ তথ্য প্রায় সকলেরই জানা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ। বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ বাংলাদেশি কর্মোপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এরা যদি বিদেশে কর্মসংস্থান না করতে পারতো তাহলে দেশের বেকার সমস্যা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতো। দেশের আর্থিক গতিশীলতা অর্জিত হতো না।
এক সময় বাংলাদেশ বিশ্ব শ্রমবাজারে একচেটিয়াভাবে দাপট দেখালেও এখন বেশ কিছু প্রতিযোগিতা সামলাতে হচ্ছে। কারণ, বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন এবং শ্রীলংকা। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি সামান্য কয়েকটি দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জনশক্তি রফতানি করা হয়ে থাকে। প্রথাগতভাবেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর, যা এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সম্প্রসারিত করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
অতীতের কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে জানা যায়, মোট রফতানিকৃত জনশক্তির ৪৮ শতাংশই পাঠানো হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ ছাড়া সৌদি আরবে ১৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১৫ শতাংশ, ওমানে ৬ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৬ শতাংশ জনশক্তি রফতানি করা হয়। অবশিষ্ট জনশক্তি রফতানি করা হয় অন্যান্য দেশে। এই চিত্রটি আর নেই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার কারণে। ক্রমে ক্রমে নানা বিরূপতায় বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার হারাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতিও বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে প্রতিকূল হচ্ছে।
এমন অবস্থায় ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো গেলে এ খাতের আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানির সুযোগ রয়েছে। আগামীতে বিশেষ করে মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে লাখ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২৬ মিলিয়ন দক্ষ শ্রমশক্তি প্রয়োজন হবে। পশ্চিম ইউরোপে ৪৬ মিলিয়ন দক্ষ জনশক্তির আবশ্যকতা দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন।
অদক্ষ শ্রম শক্তির পাশাপাশি ভাগ্য খুলবে শিক্ষিতদেরও। কারণ বর্তমান বিশ্বে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ গ্রাজুয়েট আন্তর্জাতিকমানের চাকরি করার যোগ্যতা রাখে। ফলে আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। সেই চাহিদা পূরণে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার দরকার আছে। আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হলে সুযোগ কাজে লাগানো সহজ হবে।
অর্থনীতির বিকাশে জনসংখ্যা রফতানি নিশ্চিত বিনিয়োগ তুল্য। নিশ্চিত বিনিয়োগ ও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবেও জনসংখ্যা রফতানিকে বিবেচনা করা যায়। বিশেষ করে, শ্রম বাহার বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের কূটনীতিক তৎপরতা জোরদার করা অপরিহার্য। শ্রম শক্তি ও জনশক্তি রফতানির সুফল ও রেমিটেন্স প্রবাহ অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে যুক্ত করার জন্য সরকারকে পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে রেমিটেন্স আয় আরো বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা ঝামেলা হ্রাস করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা প্রেরণের পথ রুদ্ধ করতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, জনশক্তি রফতানি খাতটি মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ সীমিত। ফলে বিদেশ গমনকারীদের নানা হয়রানি শিকার হতে হচ্ছে। বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে ও নানাভাবে প্রতারিত হতে হচ্ছে লোকজন।
এক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বাড়ানো হলে বিদ্যমান সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব হতো। কারণ, দিনে দিনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জনশক্তি রফতানি খাত হয়ে উঠছে বিশাল মহীরুহ। ফলে এ খাতের বিপুল সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি মিলিত শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়া অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৭
এমপি/জেডএম