ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যার ধর্ম তার কাছে

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১
যার ধর্ম তার কাছে

নারীনেত্রী শিরিন হক ও অকালপ্রয়াত নাসরিন হকের মায়ের নামটি এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ধর্ম নিয়ে আমাদের দুই নেত্রী খালেদা-হাসিনার সর্বশেষ বাহাসের রিপোর্ট পড়তে পড়তে তার কথা খুব মনে পড়েছে।

এরশাদ যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের চোখ ভিন্ন দিকে সরানোর মতলবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন, তখন এর বিরুদ্ধে দেশের সুশীল সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে শিরীন হকদের সংগঠন নারীপক্ষও তুমুল সক্রিয় ছিল। ধানম-ির ১৫ নম্বর সড়কের বাড়িটি রাষ্ট্রধর্মবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রও হয়ে উঠেছিল সে সময়। তাদের বিদূষী বয়সী মা তখন আমাদের সামনে ছড়া কেটে বলতেন, ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে’! আমাদের রিপোর্টিং’এ সে পংক্তিটিও তখন উঠে আসে। পরে সেটিকে সেøাগান হিসেবে নেয় সিপিবি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি হয় ধর্মভিত্তিক। ভারতীয় সমাজের বর্ণবৈষম্য প্রথার মতো তেমন একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের নামে আপার ক্লাস লোয়ার ক্লাস মুসলমান চিন্তায় বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের জঘন্য বৈষম্য আমরা দেখেছি। সেই উর্দুকে তারা যে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, সেটিও তাদের সো-কল্ড উর্বর চিন্তার ফসল। বাংলাকে তারা দেখেছে গেঁয়ো চাষাভূষা বাঙ্গালের ভাষা! উর্দু ভাষা মানে বনেদি মুসলমানদের! আর মুক্তিযুদ্ধের সময়তো লুঙ্গি খুলে খুলে দেখে সন্তুষ্ট হতে চেয়েছে আমরা সত্যি সত্যি ঠিকমতো খৎনা করা মুসলমান কীনা!
 
ধর্মের নামে এমন আরও অনেক শোষণ-বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এমন একটি দেশ বাংলাদেশ চায়, যেখানে সাবেকি তিক্ত পাকিস্তানি অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়। পাকিস্তানি আর রাজাকার আল বদরদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে হত্যা-ধর্ষণ-রাহাজানি-লুটপাটের অভিজ্ঞতায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন-পরিচালনা নিষিদ্ধ রাখা হয় বাহাত্তরের সংবিধানে। কিন্তু সেই স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানিদের মতো বন্দুক দেখিয়ে দু’জন জেনারেল আমাদের পাকিস্তানি পুরনো পথে ফের টেনে নিয়ে গেলেন!

পচাত্তরের হত্যাকা-ের পর জিয়া বাহাত্তরের সংবিধানের বিধানটি বাতিল করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র বিরোধিতাকারী পাকিস্তানপন্থী মোল্লা-মুফতি সবাই আবার সদলবলে রাজনীতিতে ফিরে আসে! করাচিতে বড় হওয়াতে জিয়াউর রহমানের বাংলা-আরবি উচ্চারণ ত্রুটিমুক্ত ছিলেন না। আজকের দিনে দেশের রাজনীতিতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজনের তিনি পাইওনিয়ার! কিন্তু তার ভাষণের ক্যাসেট শুনে দেখুন। সব সময়ই বলতেন, ‘বেসমেল্লাহির রাহমানির রাহিম’! শুদ্ধ করে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলতেন না বা বলতে পারতেন না।

ঢাকায় একজন সিনিয়র সাংবাদিক এখনও পেশায় সক্রিয় আছেন। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে ভদ্রলোক পিআইডির প্রধান ছিলেন। তার মুখে শোনা গল্পটি এ রকম, এক রোজার সকালে জিয়া তাকে সেনানিবাসের বাসায় ডেকে নেন। কিন্তু বৈঠকখানায় না বসিয়ে সোজা ডেকে নেন তার শয়নকক্ষে। এ ব্যাপারে জিয়ার বক্তব্য ছিল, বৈঠকখানায় মুসলমানগুলো বসে আছে। আমরা তাদের সামনে ব্রেকফাস্ট করতে পারব না। আগে ব্রেকফাস্ট করে নেই। তারপর কাজের কথা বলা যাবে।
এরশাদের বহুগামিতা কোনও লুকোছাপার বিষয় না। নিজে পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিয়ে আরেকজনের স্ত্রী জিনাতের সঙ্গে তার পরকীয়ার কথা প্রকাশ করেছেন। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা অবশ্য এসব কিছুকে তাদের নেতার ক্ষমতা হিসাবে জানতেন-বলতেন! সেই বহুগামী এরশাদ দেশের মানুষকে শোনাতেন ধর্মের কথা! রাজধানীর নানান মসজিদে শুক্রবার তার জুমার জামাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ডিজিএফআই-এনএসআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আগাম রেকিসহ কতই না পরিশ্রম-নজরদারি করতে হতো! আর সেই এরশাদ কিনা জুমার পর বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে আগের রাতে মসজিদটিতে আসার স্বপ্ন দেখার মিথ্যা ভাষণ দিতেন! এমন কিসিমের দুই জেনারেলের ধর্মীয় অবদান (!) কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতও আর মুছে দেবার সাহস পায়নি!

এরপরতো আরও অনেক কিছুতে পরিবর্তন এসেছে! ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’, এই দাবিকে চেঁচিয়ে-চিল্লিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে মুজিব কোটের সঙ্গে মাথায় আবার একটা ধবল সাদা গোল টুপি পড়ার বাতিক বেড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের! বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগাররাও গড়ে তুলেছেন হাজার হাজার ভোটের মাদ্রাসা! যে দেশে এমনিতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও কাজের নিশ্চিত ব্যবস্থা-বাজার নেই, মাদ্রাসা পড়ুয়াদের তো বলতে গেলে দেশে কোন জব সেক্টরই নেই!

অবশ্য বেশিরভাগ মাদ্রাসায় তাদের ইহকালের জব সেক্টর নিয়ে চিন্তা করতে পড়ানোও হয় না। পরকালে বেহেস্তে যাবার ট্রেনিং দেওয়া হয়! বাস্তবের মাটিতে গিয়ে তারা পড়েন বিপদে। তাদের কেউ বিপদগামী জঙ্গি অথবা দেশের দুই নেত্রীর ভোটের উপকরণ হন! যে দেশের প্রতি ভোটের আগে খালেদা জিয়ার মতো শেখ হাসিনাও ওমরাহ হজে যান। খালেদা হিজাবটি ঢাকাগামী ফ্লাইটে চড়ার পরপর খুলে ফেললেও, হাসিনা সেটি কয়েকদিন রাখেন। ইলেকশনের সময়েও যার যার সুবিধামতো ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করেন দুই নেত্রী! খালেদা জিয়া জামায়াতকে বগলদাবা রেখেছেন দেখে শেখ হাসিনা শায়খুল হাদিসের সঙ্গে ফতোয়া চুক্তিতে পিছপা হন না!
 
গত দুইযুগের বেশি সময় ধরে এই দুই নেত্রীর দাপুটে অবস্থার কারণে অবশ্য এই মাওলানা-মুফতিদের ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ফতোয়াটিও আর বিশেষ শোনা যায় না। উল্টো এই মাওলানা-মুফতিরা কোনওভাবে জোটগত একটি এমপি পদের জন্য এই দুইনেত্রীর কৃপা প্রার্থনা করেন! পারলে পা ধরেন! কারণ ধর্মের নামে তাদের লেবাসটি জনগণের সামনে এত বেশি প্রকাশিত যে সে কারণে প্রায় পচানব্বই শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার দেশেও ভোটের রাজনীতিতে তারা মোটেই পপুলার না। দুইনেত্রীর কৃপা ছাড়া এদের কারোরই নির্বাচনে জেতার কোনো সুযোগও নেই। এর আরেকটি বড় কারণ দেশের মুসলিম জনসংখ্যার সিংহভাগ ব্যক্তিজীবনে খোদাভক্ত ধর্মভীরু হলেও মানসিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অসাম্প্রদায়িক-ধর্ম নিরপেক্ষ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার খালেদা জিয়ার কৃপায় থাকায় মাওলানা-মুফতি-আল্লামা সবাই গো-হারা হেরেছেন!
 
সেই দেশটিতেই খালেদা-হাসিনা আবার শুরু করেছেন ধর্মের নামে নয়া এক বাহাস! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দেখতে যাওয়ায় খালেদা জিয়া কিনা তাঁকে কটাক্ষ করে বললেন, এ সরকার এখন দেবদেবীর পূজা করা শুরু করেছে। পূজা দেখতে গিয়ে বলেছে, মা গজে চড়ে এসেছে। ’ এভাবে শেখ হাসিনার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, তারা আল্লাহ-খোদা মানে না। সংবিধান থেকে আল্লাহ-খোদার নাম তুলে দিয়েছে, ইত্যাদি!
 
আর ঢিলের বদলে পাটকেলের মতো এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রশ্ন রেখেছেন আমি মুসলমান কি না? আমি বলতে চাই বিরোধীদলীয় নেত্রীকে, আমি ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরীফ তেলওয়াত করি। কিন্তু আপনি কয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন? আপনি তো দুপুর ১২টায় ঘুম থেকে ওঠেন। এখন কে মুসলমান বুঝে নিন’।

খালেদার দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার বিষয়টি অবশ্য তার দলের নেতা-কর্মী বা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে নতুন না। প্রধানমন্ত্রী থাকতেও পারতপক্ষে সকালের দিকে তার কোনো প্রোগ্রাম রাখা হতো না বা রাখা থাকলেও তিনি সেগুলোয় দেরি করে পৌঁছতেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনাকে চটজলদি গ্রেপ্তার করে ফেলা হলেও প্রয়াত সাবেক জেনারেলের বউ খালেদাকে অনেকদিন গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ওই অবস্থায় তার দিনলিপি বা নড়াচড়ার বিষয়টিও খবর হয়।
 
খালেদা জিয়ার ওপর নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা তখন কথায় কথায় বলেন, ‘ম্যাডাম অনেক দেরিতে ঘুমান তো, তাই সকালে দেরি করে ওঠেন। ’
‘দেরিতে ঘুমান মানে, অতক্ষণ জেগে থেকে কী করেন?’—
জবাব আসে-- ‘টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখেন। ’
ভারতীয় চ্যানেলগুলোর অসম্ভব ভক্ত-পোকা খালেদা জিয়া। সাধারণত এসব জনপ্রিয় সিরিয়ালের  কোনোটিই তিনি মিস করতে চান না।

এরপর ভালো শ্রোতা পেয়ে ওই কর্মকর্তা এর সঙ্গে যোগ করে বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সরকারি কাজের ব্যস্ততায় যে সব সিরিয়াল তিনি সময়মতো দেখতে পারতেন না সেগুলো তার জন্য রেকর্ড করে রাখা হতো। পরে রেকর্ডেড ক্যাসেট-সিডি থেকে তিনি সেগুলো দেখে নিতেন। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠায় দিনটা দেরিতে শুরু হওয়াতে বিকেল বা সন্ধ্যার আগে নিজের গুলশানের অফিসেও খালেদা জিয়া যান না বা যেতে পারেন না। সে কারণে বিএনপি তথা খালেদা জিয়া বিটের রিপোর্টাররাও জানেন, রাত না  হলে নড়ে না অথবা জমে না এ দল!’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ত এখন তার কাছে জমা গোয়েন্দা তথ্যের সূত্রে বলেছেন খালেদা জিয়া দুপুর ১২টায় ঘুম থেকে ওঠার কথা বলেছেন! ঘোর প্রতিপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া ধর্ম বিষয়ক ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাবটি তিনি বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গেই দিয়েছেন। কিন্তু দেশের মানুষ এসব ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে দুইনেত্রীর বাহাস দেখতে-শুনতে মোটেই ইচ্ছুক না। বা সিলি এসব বিষয় দেশের মানুষের সমস্যাও না। জীবনের সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত তাদের কাছে সেই কথাটিই সত্য, ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে’!

ফজলুল বারী: সিডি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।