ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সেঁজুতিকে ফেরানো গেলো না!

সুমি খান, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১
সেঁজুতিকে ফেরানো গেলো না!

সাংবাদিকতার সাথে নৈতিকতার বৈরিতা নাকি বন্ধুত্ব? কার কাছে দায়বদ্ধ আজকের সাংবাদিকতা? পুঁজি,  ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ আর হিংসা প্রতিহিংসার কাছে? তাহলে বিবেক কোথায় বন্দী রেখেছেন তারা? এ প্রশ্ন আজ বড়ো জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে সাংবাদিক এবং পাঠকদের মনে।

বলছি সেঁজুতির কথা।

যার পিতা সাহসী সাংবাদিক যশোরের শামসুর রহমান কেবল। যিনি ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন সাংবাদিকতার জন্যে। ভীষণ মেধাবী ছাত্রী সেঁজুতি সাংবাদিক  হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলো। হলো না। জার্মানি চলে যাচ্ছে। তার ভাষায়, ‘আপু, আমার বাবার বন্ধুরা তাদের  সন্তানের মতো ছায়া দিয়েছিলেন। তবু আমার বলতে হচ্ছে- বাংলাদেশে মেয়েরা সাংবাদিকতা করতে পারবে না। আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনো দেশে ফিরবো না। কে ফেরাবে সেঁজুতিকে? অক্ষম আমি তবু  বেদনাভরা কণ্ঠে বলি- উচ্চশিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে এসো। যদি বেঁচে থাকি, আর সেই ক্ষমতা যদি অর্জন করি, তোমাকে উপযুক্ত জায়গায় স্থান করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। ’
 
কোন সহজ সমীকরণ করা সম্ভব নয়। তবে সাদা চোখে যা দেখা যায়- এই প্রজন্মের টিম লিডারদের কাছে নীতি নৈতিকতার চেয়ে নিউজরুমকে নির্দিষ্ট ‘গোষ্ঠী/দলবাজ’ এর চারণভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। কখনো চাঁদাবাজ আর অনৈতিক ব্যক্তিদের সা¤্রাজ্য এবং পুনর্বাসনকেন্দ্রেও পরিণত হচ্ছে নিউজরুম- তৈরি করছে একের পর এক নষ্ট প্রজন্ম; প্রতি মুহূর্তে যাদের অহংকার আর প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে পেশাদার সংবাদকর্মীরা।

মনে পড়ে কোন এক টিভি চ্যানেলে চিফ রিপোর্টার সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা হলেন। অন্য একটি চ্যানেলে সিনিয়র রিপোর্টার পদ থেকে নতুনভাবে শুরু হ্ওয়া চ্যানেলটিতে চিফ রিপোর্টারের পদ পেলেন। তখন ‘ধরা’ যেন তার কাছে ‘সরা’। ওয়্যারলেস হাতে টিভি ভবনের নিচতলা থেকে ওপরতলা ছুটে বেড়াচ্ছেন আর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। হেড অব নিউজ, সিএনই তার কথায় ‘জি হুজুর’ ছিলেন। মিথ্যে অহং এর সব ফাঁকা আওয়াজ একদিন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। শুধু আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একদিন পুরো নিউজরুম ভেঙে পড়লো। সেই নিউজরুম আর দাঁড়াতেই পারলো না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বললেও হয়।
 
আর ব্যক্তিস্বার্থলোভী সেই চিফ রিপোর্টার এখন আরেকটি নতুন নিউজরুম তৈরির চেষ্টায়। আরো বড় পদে, বেশি বেতনে। টাকা, পদ সবই আছে নেই অন-এয়ার চ্যানেল। আর যে সিএনই, হেড অব নিউজ তার অধীনস্থ ছিলেন, তারা এখন অন্য নিউজরুমে। কতোটা তিক্ত হলে তারা এক জায়গায় আর থাকলেন না- এটাও একটা প্রশ্ন বটে।

কলুষিত সাংবাদিকতার বিষবাষ্প নিভিয়ে দিচ্ছে এই পেশার পবিত্রতা আর সৌন্দযের্র আলো- সেসব কলুষিত ব্যক্তির অন্যায় অপরাধ এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ধিক্কার জানাতেই আমার এ লেখা।

জানি এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আমার কাজের ক্ষেত্রে অনেক সংকট এমনকি বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তবু কিছু মানুষের মতো আমার কাছে ও সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়। আমার সাধনা, কর্ম এবং ধ্যান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাবেক এবং বর্তমান সিনিয়র জুনিয়র অনেক সহকর্মী বিভিন্ন সময়ে গভীর হতাশায় তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন আমার সাথে। যে কারণে এ লেখার তাড়না অনুভব করছিলাম অনেকদিন থেকে।

ছোট্ট একটি লেখা সাংবাদিকতার গুণগত পরিবর্তনে কতোটা সহায়ক হবে জানি না। তবু একজন সংবাদকর্মীর লেখাই তার মুক্তি, শক্তি এবং প্রেরণা। তাই যতোক্ষণ এ দেহে প্রাণ আছে, আমার লেখার মাধ্যমে সকল নৈরাজ্য আর অন্যায়ের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে- এ আমার অঙ্গীকার।

লেখার শুরুতেই করজোরে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যদি আমার এ লেখা নিরীহ কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকে। সেটা আমার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ এবং আমার মতো একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীর আত্মগ্লানি এবং বেদনার এ প্রকাশ যদি ধৃষ্টতা হয়ে থাকে, ক্ষমা করবেন আমার শ্রদ্ধাভাজন গুরুজনেরা, বন্ধু-স্বজন সহকর্মীরা। একই সাথে বিনীতভাবে বলি এই লেখা কোনোভাবেই মিডিয়ায় কর্মরত নারীদের অবমাননা করার জন্যে নয়। তা ভাবা হলে লেখাটির অপব্যাখ্যা করা হবে।

কথায় বলে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তবু সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস বলে যুগে যুগে মনীষীদের দিকনির্দেশনা আর সতর্কবাণী দূর করে দেয় অনেক অন্ধকার। তাদের অমোঘ বাণী তাই  অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরকাল প্রেরণা জোগায়, শক্তি দেয়। সেই শক্তিতেই এ লেখার অবতারণা।

গণমাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরেন সাংবাদিক। নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, পরিশ্রম, সততা এবং নিষ্ঠা সাংবাদিকতার প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসব চিত্র বিরল। এ পেশার সকল ঝুঁকি, প্রতিকূলতা মেনে নিয়েই চ্যালেঞ্জিং এ পেশা বেছে নেন সাংবাদিকেরা। সমাজের অন্য পেশার মতো এ পেশাতেও অনেক কলুষ, অনেক ফাঁকি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক।

হতাশাজনক এ বাস্তবতা আলোচিত বিশ্বজুড়ে। নিজেদের মধ্যে চরম অসঙ্গতি রেখে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা যায় না, সর্বনাশের আস্তাকুঁড়ে ডুবে যেতে হয়।

বাংলাদেশে ইলেক্ট্রানিক মিডিয়ার বয়স খুব বেশি নয়। অনলাইন, প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। যেন ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান’। প্রতিটি গণমাধ্যম নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে মরিয়া। ইন্টারনেট মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়েছে অনেক। যে কোনো তথ্য মুহূর্তের মধ্যে আলোর গতিতে যেন ছুটে আসে মানুষের কাছে। তথ্যের আদান প্রদানে তাই বেড়েছে প্রতিযোগিতা।
 
এ প্রতিযোগিতা যতোক্ষণ সুস্থ থাকছে, এর সৌন্দর্য এবং পেশাদারিত্ব নানাভাবে সমৃদ্ধ করছে গণমাধ্যমকে।

ব্যক্তিপর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা না থাকায় সেই প্রতিযোগিতা দিনে দিনে কদর্য রূপ নিচ্ছে। বিপন্ন করে তুলছে সৎ সাংবাদিকতাকে। নষ্ট করে দিচ্ছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহমর্মিতা। সাংবাদিকতার জন্যে এ বড়ো বিপজ্জনক।

ষাটের দশকেই সাংবাদিকতা পেশায় আসার মতো যোগ্যতা এবং সাহস এদেশের কিছু নারীর ছিল। এ পেশায় নারীর অর্জন বড়ো কমও নয়। চরম বৈষম্যের কারণে যার মূল্যায়ন কখনোই হয়নি।

সমাজ এখনো মধ্যযুগে যেন। নারীর মেধা, শ্রম এবং সততার স্বীকৃতি দূরে থাক তার অর্জনের মূল্যায়ন এবং নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে গ্রহণ করতে কোনোভাবেই প্রস্তুত নয় কিছু পুরুষ সহকর্মী। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এদের জন্যেই ‘কাপুরুষ’ শব্দের জন্ম। কিছু সুবিধাভোগী নারী হীনস্বার্থে এ কাজে সেই কাপুরুষদের সহায়ক শক্তি। যে কারণে এ পেশায় নারীর সংখ্যা এখনো খুবই কম। দিনে দিনে জুনিয়র থেকে তস্য জুনিয়রকে মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্যে বসিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে আকাটমূর্খও পুরুষ হওয়ার বদৌলতে গৌরবের সাথে সেই সুযোগ পায়। এই বাস্তবতায় প্রাপ্তি যতোই কম হোক, কিছু নারী পরিবার-স্বজন-সামাজিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় নিবেদিত।
 
একেবারে দশভূজা। চরম অসহযোগিতার পরও তার এ অসীম ধৈর্য এবং অর্জনে আরো যেন ক্ষিপ্ত কিছু মানুষ। তাদের হিংসা রূপ নেয় প্রতিহিংসায়। নারীর প্রতিকূলতা বেড়েই যায়।

টেলিভিশন স্ক্রিনে দেখা যাওয়ার আকর্ষণে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতি সাংবাদিকদের আগ্রহ বেড়েছে অনেক। সেটাকে পুঁজি করে রুচিহীন শিক্ষা সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এখানে প্রাসঙ্গিক। একটি প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশনের ডেস্কে দীর্ঘদিন কাজ করছে এক তরুণী। রিপোর্টিংয়ে তার আগ্রহের কথা জানায় সিনিয়রকে। জবাব এলো- ‘ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে আমার সাথে। হতভম্ব তরুণীর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে আবার সেই সিনিয়র বললেন, ‘স্পেশাল ফেন্ডশিপ’। ভীত সন্ত্রস্ত তরুণী আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে চলে যায় তার নিজের কাজে। এ চিত্র নিত্যদিনের। প্রায় সব মিডিয়া হাউজেই। এমন অন্যায় প্রতিরোধের সাহস দেখানোর জায়গা কোথায়?

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?’  আমার মনে হয়, নারীকে তার যোগ্যতার মূল্যায়নে বিধাতার চেয়ে ব্যক্তি পুরুষ অনেক বেশি স্বার্থপর। যাকে স্বৈরাচার বললে বেশি বলা হবে না। নীতিনির্ধারক তার দায়িত্বে থেকে এতোটাই হিংসুটে এবং কুঁচুটে আচরণ করেন।

যে পেশাদারিত্ব দেখাতে চায়, তার প্রতি বার্তাপ্রধানের ভাষা যদি হয়, ‘তাকে কোনোভাবেই স্ক্রিনে আসতে দিবা না। ছুটিয়ে মারবা। শেষ মুহূর্তে আর যাবে না। ’ সেই বার্তাপ্রধান একই সাথে বলে যান, ‘সীতা-গীতা-আনু-খলিল-জলিল-মবিল-জামিল শুধু স্ক্রিনে থাকবে। বারবার দেখাবা। নিউজে প্রেজেন্টেশানে গাজী থাকবে প্রাইমে.. প্রোমেতেও .. ... আর বলতে হবে?’

চামচারা জবাব দেয়- বুঝছি বস। আর লাগবো না। ’ মালিকের টাকা তো খোলামকুচি। শনৈ: শনৈ: প্রোমোশান দিতে হবে এই চামচাদের। কর্পোরেট হাউসের সাথে মিডিয়ার মেলে না। প্রশ্ন আসে এটা তো কোনও নিয়মে পড়ে না। বার্তাকক্ষ প্রধান জবাব দেন, ‘না হয় ‘আমার’ (?) স্ক্রিন (!?!) ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’ সত্য বটে। তার নিজের স্ক্রিন বটে। এমন দলবাজিই যদি করা না যায়, সাংবাদিকতা আর হলো কী করে? তার আর সাংবাদিকতা করার সুযোগ হয় কি? অন্তত সেই জায়গায়?

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাদের বলেছেন ধূর্ত বুদ্ধিজীবী (বুদ্ধি যাদের জীবিকা)। যারা তাদের বুদ্ধির ছলে তৈরি করছেন ‘হস্তি-মূর্খ’ প্রজন্ম। এই লোভী, প্রবঞ্চকদের ধূর্ততা নতুন প্রজন্মের একটি অংশের তারুণ্য এবং তারুণ্যের নির্মল সরল সৌন্দর্য হত্যা করছে।

সাংবাদিকতার ‘বিলবোর্ডে’ (সাংবাদিকতা এখন আর সাইনবোর্ড নয়, বিলবোর্ডে পরিণত হয়েছে)। এর পেছনে ‘ব্রাউন এনভেলাপ জার্নালিজম’, নারী সহকর্মীদের অপমান করে বিকৃত আনন্দ উপভোগ, অথবা  প্রতিহিংসার বিষাক্ত নিঃশ্বাস বরাবরই বেশ পরিচিত চিত্র।

সমাজের যতো কলুষ, যতো পাপ এবং অনাচার- তার প্রথম শিকার পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে নারীর কথাই বলতে হয়। কতোটা সময় পেরুলে তবে যথাযথ মূল্যায়ন হবে তার?
 
অশ্লীল বাক্যবাণ, মোবাইল মেসেজ, মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে একজন সহকর্মীর ক্যারিয়ার স্তব্ধ করার বিকৃত আনন্দের উল্লাস কারো কারো চোখেমুখে যেন উছলে পড়ে।

এই চিত্র অনেকটাই দৃশ্যমান। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো- সব জেনে বুঝেও এসব অন্যায়ের সাথে আপস করছেন নীতিনির্ধারকেরা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সত্যনিষ্ঠ এমন ব্যক্তিসত্তা একেবারেই দৃশ্যমান নয়। প্রতিবাদী হলে যে মিথ্যাচার এবং সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়!

আবার নজরুলের কথায় আসি। তার ‘নারী’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘শোনো মর্ত্যরে জীব, অন্যেরে যতো করিবে পীড়ন, নিজে হবে ততো ক্লীব!’ এই ক্লীব শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যদি ধারণা হয়ে থাকে- এদেশের মিডিয়া তাদের নষ্ট, পুঁতিগন্ধময় হাতের মুঠোয় চিরকাল বন্দী হয়ে থাকবে- ভুল। অবশ্য যারা নিজেদের পঙ্কিলতার অন্ধকারে ডুবিয়ে বেশ গর্বিত ভাবেন-তাদের বিবেকবোধ থাকে না। অবাধ মিথ্যাচার আর প্রলোভনের কাছে তাদের বিবেক বেচে নিজেরাই তাদের বিবেকের গলা টিপে মেরে ফেলেছেন অনেক আগে। তারা যে দুই কান কাটা।

সাংবাদিক পরিচিতির আইডি কার্ডের জোরে যশ, খ্যাতি, অবৈধ মাসোহারা, চাঁদাবাজি, রাজধানীর বুকে জমি, গাড়ি-বাড়ি- ফ্ল্যাট আর অ্যাপার্টমেন্টের বিলাসিতায় আয়েশী শরীর যতোই ডুবে যাক না কেন, একদিন সেই মিথ্যে মোহ কাচের ঘরের মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ে। খুলে যায় তাদের মুখোশ। সেদিন সুকুমার রায়ের ভাষায় ধ্রিম, পতন, আর মূর্ছা গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কীইবা করার থাকে? লোভ, ঈর্ষা আর প্রতিহিংসার মহোৎসব বড়ো ক্ষণস্থায়ী। তাতে মুক্তি নেই। কেবলই অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলা। একের পর এক অন্ধকার পথের চোরাবালিতে নিজেকে তলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গোটা সমাজটাকেই তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।

আশার কথা- অসাধারণ কিছু নেতৃত্ব থাকে। যদিও খুবই  বিরল। তাদের কারণে এতো সংকটের মাঝেও সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বিস্তৃত হয়েছে। সংজ্ঞায়িত হচ্ছে নানান ব্যাখ্যায়। সমৃদ্ধ হচ্ছে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী কাজে। এর পেছনে অবদান অনেকের। যারা সামাজিক দায়বদ্ধতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যারা প্রচ- মানসিক পীড়নে জর্জরিত হয়েও সকল প্রতিকূলতাকে পায়ে দলে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। তবে এও সত্যি, কেউ কেউ নানান টানাপোড়েনে দীর্ঘদিন প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে কাজ করার অর্জন পেছনে ফেলে এ পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন।

যে শিক্ষকের সব ছাত্র ভালো ফলাফল করতে পারে না- সেই শিক্ষকের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। বলা হয়, তিনি যদি তার সব ছাত্রের প্রতি মনোযোগী না হন, তবে তার শিক্ষক হিসেবে সার্থকতা কোথায়?  বার্তাপ্রধানরা কি কখনো তার টিমের প্রত্যেককে যথাযথভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে তার থেকে কাজ বের করে আনার কথা ভাবেন? ভাবেন কি এতে টিআরপি কতোটা বাড়ানো যায়? বলেন কি কখনো, আমরা একটা টিম সবাই একসাথে কাজ করবো? না, বলেন না। কেন বলেন না? তবে কি এই বার্তাপ্রধানরা যে পদেই থাকুন না কেন, তাদের হাত পা বাঁধা- মিথ্যে মোহ আর অন্ধকারের শক্তির কাছে?

যার কারণে ধস নেমে আসছে একের পর এক মিডিয়া হাউসে। আর চোখ বুঁজে দোষ দেওয়া হয় এককভাবে মালিক পক্ষের ওপর। যদি মালিক পক্ষ সংবাদের গলা টিপে ধরেন, তবে তা সত্যিই হস্তক্ষেপ করা। সেটা কি সব সময় হয়? মিডিয়ার এ সংকটের জন্যে মালিকপক্ষ বা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন কতোটা দায়ী?  সেটা বিবেচনাার সময় এসেছে। আসুন আমরা এবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি। অন্ধকারকে জয় করার সময় এসেছে।

নতুনদের বলি, ‘কে আছো জওয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ...!’ বিপন্ন সৎ সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে কঠিন হাতে। একশ’ বছর আগে কাঙাল হরিনাথ বলেছিলেন, ‘সৎ সাংবাদিকের কোন বন্ধু থাকতে নেই। ’ আজ একশ’ বছর পর আমার সহকর্মীদের বলি, নিজেদের মধ্যে আর বিচ্ছিন্নতা নয়। প্রতিহিংসা নয়। একে অপরের সহযোগী এবং সহায়ক শক্তি যেন হয়ে উঠতে পারি। পেশাদারী মনোভাব নিয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতায় সমৃদ্ধ করতে হবে সাংবাদিকতাকে।

হিংসা আর মিথ্যা দম্ভ সর্বনাশ ডেকে আনে। এ থেকে কারো মুক্তি নেই। সত্য একদিন দিনের আলোর মতো উদ্ভাসিত হয়। সেদিন যেন নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমাদের লজ্জা পেতে না হয়। আমি বিশ্বাস করতে চাই মিথ্যের কাছে বিবেক বন্দী রেখে নয়; মুক্ত চিন্তা নিয়ে ভয়শূন্য চিত্তে মাথা উঁচু করে কথা বলবে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক। নুরুলদিন ডেকে বলে, ‘জাগো বাহে, কোন্ঠে সবাই ...!!’

সবশেষে আবারো নজরুলের ভাষায় বলি, ‘বন্ধুগো, বলিতে পারি না, বড়ো বিষজা¡লা এই বুকে। দেখিয়া-শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি- তাই যাহা আসে কই মুখে। ’ সত্যকে মেনে নেবার সৎসাহসে সকল শুভ শক্তিকে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে অনেকদূর। বিনাশ করতে হবে সকল অশুভ শক্তি, অন্যায় আর হিংসা। বন্দী বিবেককে এবার মুক্ত করে দেওয়া হোক। জয় হোক সত্যের। জয় হোক সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার।

লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।