২০০৯ সালের জুন বা জুলাই। আমি তখন একটা দৈনিকে কাজ করি।
নরসিংদী প্রতিনিধি বলেন, `আমারেতো দারোয়ান দাঁড় কইরা রাখছে ২০ মিনিট ধইরা। ভিতরে ঢুকতে দিতাছে না। দারোয়ানকে বললাম তিন মাস আগে জয়েন করেছি এখনও পত্রিকার আইডি কার্ড পাই নাই। এদিকে মফস্বল ডেস্কের কেউ ফোন ধরতাছে না। আপনিও না। কি নাজেহাল অবস্থা রে ভাই। `
পরে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক-টেক করে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হলো এ সাংবাদিককে। আফসোস করে বললেন, ‘রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রিপোর্ট করি অথচ নিজের হেড অফিসে ঢুকতেই এই অবস্থা। ’ ভিতরে ঢুকেও একপ্রকার অপমান বোধ করলেন এ মফস্বল সাংবাদিক। মফস্বল ডেস্কের অনেকেই তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেননি। তিন/চারবার কিছু জিজ্ঞেস করলে একবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বা না সূচক জবাব দেয়। এ প্রতিনিধি ভেবেছিলেন সম্পাদকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যাবেন। সাহস করে সম্পাদকের রুমের দিকে যাচ্ছিলেনও। হঠাৎ সম্পাদকের পিএ বলছেন-‘এই এই কই যান আপনি? এডিটর লাঞ্চ করসে মাত্র, এখন ঘুমাইতেসে, এক ঘণ্টা রুমে যাওয়া যাবে না। ’ এক ঘণ্টা বসে ছিলেন এ সাংবাদিক। সম্পাদকের ঘুম ভাঙলে হেড অফিসের সাংবাদিকদের যাতায়াত। ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন নরসিংদী থেকে আসা এ সাংবাদিক। একপর্যায়ে সম্পাদক রুম থেকে বের হলে সাহস করে এ প্রতিনিধি সম্পাদকের উদ্দেশ্য বললেন, ‘আমি নরসিংদী প্রতিনিধি। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আপনার জন্য। ’ ব্যস্ত সম্পাদক হাঁটতে হাঁটতে তাকে বললেন, ‘পরে পরে, এখন সময় নেই। পিক আওয়ার চলছে দেখছো না। ’ পত্রিকাটির সম্পাদক পাত্তাই দিলেন না তাকে।
জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধিদের এরকম দুঃখবোধ আছে অনেকেরই। হেড অফিসে নানা কৈফিয়ত দিয়ে ঢুকতে হয় মফস্বলের সাংবাদিকদের। দারোয়ানকে কৈফিয়ত দেওয়া। রিসেপশনে নাম লেখা। কার কাছে যাবে? কেন যাবে নানা রকম কৈফিয়ত দিয়ে তবেই হেড অফিসে ঢোকা। ভিতরে প্রবেশ করে আরেক রকম অপমান। হেড অফিসের লোকজনের ভাবখানা এমন যে তারা মনে করে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা পত্রিকার কোনো সাংবাদিকই নয়। মাঝে মাঝে মফস্বল সাংবাদিকদের এরকম হেনস্থা দেখে খারাপই লাগে। করপোরেট মিডিয়ার যুগেও ঢাকা আর মফস্বল সাংবাদিকদের সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে পার্থক্য অনেক। একজন হেড অফিসের সাংবাদিক যত সুযোগ সুবিধা পান তার সিকিভাগও পান না মফস্বল সাংবাদিকরা। ওয়েজবোর্ড পাওয়াতো দূরের কথা। মফস্বল সাংবাদিকতা নিয়ে মিডিয়া মোগলরা অনেক কথাই বলে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিবছর বিভিন্ন দৈনিক জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি সম্মেলন করে মফস্বল সাংবাদিকদের নানারকম প্রতিশ্রুতি দেন সম্পাদক ও মালিকপক্ষ। কিন্তু প্রতিশ্রুতি প্রতিশ্রুতিই থেকে যায়। তা পূরণ হয় না। একজন জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধি কত টাকা বেতন পান তা বললে হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। করপোরেট মিডিয়ার যুগেও মফস্বল সাংবাদিকরা আর কতদিন বৈষম্যের স্বীকার হবেন? তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের অধিকার নিয়ে যারা লিখে যাচ্ছেন অবিরত, তাদের অধিকারের কথা কে শুনবে?
লেখকের টিকা: সহযোদ্ধা সুমি খানের মফস্বল সাংবাদিকতার ওপর লেখাটি পড়ে এ লেখার তাড়না অনুভব করলাম)
লেখক, সাংবাদিক, যোগাযোগ: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১২০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১