ঢাকা: নিকট আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সেনা অফিসার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সরকারি আমলা ও ডাকসাইটে ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাতানো নয়, রক্তের!
সুতরাং লেখা-পড়া শেষ হবার পর তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে যখন রাজধানীতে এসে ‘বিনে পয়সায়’ সাংবাদিকতা শুরু করলাম, তখন সবার চোখ কপালে উঠল।
আরেক লেফটেন্যান্ট ভাগ্নে মাঝে মধ্যেই বলত, ‘মামা, দেশ নিয়ে ভাবার অনেক লোক আছে। কত মাসে কতজন ক্রস ফায়ারে মরল সে হিসাব দিয়ে তোমার কাজ নেই। অন্য মামাদের মতো তুমিও পারিবারিক ব্যবসায় মন দেও। অথবা বিসিএস করে সরকারি আমলা বনে যাও। ’
অতি সম্প্রতি আমার বড় দুলাভাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে- তোমার বেতন নাকি বেড়ে...... হয়েছে।
আমার বেতন নিয়ে তার এই কৌতূহলের হেতুটা কি তা ব্যাখার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকটি সাংবাদ কর্মীকেই “সাংবাদিকতার পাশাপাশি আর কী করছেন”-জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে সদা প্রস্তত থাকতে হয়। উল্লেখিত কৌতূহলটাও সমগোত্রীয়।
বাংলানিউজে প্রকাশিত সুমি খানের লেখা ‘সেঁজুতির ফেরা হলো না’ ও ‘মফস্বল সাংবাদিকতার জয় হবেই’ পড়ার পর কিছু একটা লেখার তাড়না অনুভব করছিলাম ভেতরে ভেতরে। তবে সেই ভেতরটাকে বাইরে আনার যোগ্যতা ও শব্দের গাঁথুনি নির্মাণের ক্ষমতা না থাকায় বেশ ক’টা দিন কেটে গেছে কেবল ভেতরের ভয় তাড়াবার সাহস সঞ্চয় করতে। এ জন্য বলতে চাই, লেখার শুরুটা আত্মকথনের মতো শোনালেও এটিকে অপরাধ হিসেবে না নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবার আগে বিকেল বেলায় সোলতে পাকানো’ হিসেবে নিলেই কৃতার্থ হবো।
বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ মহোদয় লেখার অবারিত দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন। সেখানে নবীন-প্রবীণ, লেখক-পাঠক, শুভানুধ্যায়ি-ঘোরবিদ্বেষী (!)-সকলেই লিখছেন অবলীলায় ।
রিপোর্টিংয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে ওই লেখাগুলো পড়েই চোখ ও মনের তৃপ্তি মিটাই। লেখার ‘তাড়নাটাকে’ ব্যস্ততার শেকলে বেঁধে রাখি।
কিন্তু সুমি খানের ‘সেঁজুতির ফেরা হলো না’ ও ‘মফস্বল সাংবাদিকতার জয় হবেই’ লেখার ‘তাড়না’ ব্যস্ততার শেকল ছিঁড়িয়েছে।
সাংবাদিকতায় আমি নবীন। সুমি খানকে চিনি না। এটি আমার অপরাধ কি না জানি না। তবে সীমাবদ্ধতা মানি। বাংলানিউজে লেখা প্রকাশের পর সুমি খানের এক রানিং কলিগের সঙ্গে কথা বলে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের কথা জেনেছি। প্রীত হয়েছি।
‘সেঁজুতির ফেরা হলো না’ দিয়েই শুরু করা যাক। -
-তখন আমি ছাত্র। প্রগতিশীলদের সঙ্গে ওঠা-বসা করি। রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য ও সুন্দর’-এর চর্চায় মগ্ন। ঠিক সেই সময় দৈনিক জনকণ্ঠ আমাদের মতো তরুণদের সামনে এক অবারিত দ্বার খুলে দিল। কী সংবাদ, কী সাহিত্য, কী সংস্কৃতি, কী কলা, কী বিজ্ঞান, কী ক্যারিয়ার, কী ধর্ম, কী বিনোদন- এক কথায় সব পেয়ে গেলাম ওই জনকণ্ঠে। জনকণ্ঠ পড়তে পড়তেই এক সময় আবিষ্কার করলাম নির্ভীক সাংবাদিক শামসুর রহমানকে।
একদিন সকালে জানলাম ‘রক্তাক্ত জনপদের’ নির্ভীক সাংবাদিক শামসুর রহমান সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে হেরে গেছেন (মূলত তিনি হারেন নি, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে তিনি বিজয়ী, তিনি অগ্রসেনানী)।
এর কিছুদিন পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অকাল প্রয়াত নির্ভীক সাংবাদিক শামসুর রহমানের শোকাহত স্ত্রী ও তার সন্তানদের যশোর থেকে উড়িয়ে এনে নিজ দপ্তরে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
আমার খুব মনে আছে-ওই দিন শামসুর রহমানের অবুঝ সন্তানরা শেখ হাসিনার হাত থেকে সাদা গোলাপ গ্রহণ করেছিল। তাদেরই একজন সেঁজুতি।
বাবা প্রখ্যাত সাংবাদিক। সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত। অকাল প্রয়াত। বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সেঁজুতিও হাতে কলম তুলে নিয়েছেনÑ এ পর্যন্ত মেনে নিতে কষ্ট হয় না। বরং ভালোই লাগে। গর্ব হয় এই ভেবে যে-পারিবারিক ঐতিহ্য ছিন্ন করে আমিও আজ সেঁজুতির সহযোদ্ধা।
কিন্তু যখন সেঁজুতিরা চলে যায় এবং শুনতে হয় ওয়াকিটকি হাতে দাপিয়ে বেড়ানো সেই সব ‘সেলিব্রেটি’ সিআর-সিএনএদের চেয়ার, ক্ষমতা ক্ষেত্র বিশেষ নবীন নারী কর্মীদের শরীর দখলের খবর, তখন মনে হয় তরুণ প্রকৌশলী ও সেনা অফিসার ভাগ্নেদের পরামর্শ না শুনে ভুলই করেছি। কোথায় সত্য, কোথায় সুন্দর আর কোথায় সাংবাদিকতা?
‘মফস্বল সাংবাদিকতার জয় হবেই’-সুমি খানের এ লেখাটিতে ‘‘করে খাওয়া’র পরামর্শ ও মালিক পক্ষ থেকে যেন লেলিয়ে দেওয়া হয় আইডি কার্ড দেখিয়ে চাঁদাবাজি করার জন্যে”-এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি।
সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি অনলাইন ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার।
পত্রিকা দু’টিতে কর্মরত অবস্থায় সম্পাদক মহোদয় একদিন আমাকে একটি এসাইনমেন্ট দিলেন। সঙ্গে দিলেন কাজটি কীভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্রিফ।
সম্পাদক মহোদয়ের ব্রিফ অনুযায়ী কাজটি করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি নিউজটি যে অ্যাঙ্গেলে করতে বলছেন- বাস্তব ঘটনা তা নয়। সম্পাদকের ব্রিফ অনুযায়ী নিউজ করতে গেলে বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণœ হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমার ব্যক্তিগত সততা। সাফ জানিয়ে দিলাম- এভাবে আমার পক্ষে নিউজ করা সম্ভব না।
আমার এমন বিদ্রোহী ভাব দেখে প্রথমে হতভম্ব পরে রোষের আগুন বর্ষণ করলেন সম্পাদক। সেদিন যে ভাষায় তিনি আমাকে বললেন ও আমার সততার ওপর সন্দেহের যে কালিমা লেপনের চেষ্টা করলেন তাতেই আমার সাংবাদিকতার তেতো স্বাদ গ্রহণ পূর্ণতা পেল। অধিকন্তু একদিন পর যখন দেখলাম নিউজটি আমার নামেই ছাপা হয়েছে, তখন সাংবাদিকতার বিশেষ রং’টি (হলুদ) আমার চোখের সামনে অবিরাম উদোম নৃত্য করল। প্রচ- ক্ষোভে ও অভিমানে দিন কয়েক অসুস্থ হয়ে পড়ে র’লাম বিছানায়।
পরে জানতে পারলুম, মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বন্ধুর মন যোগাতে আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের সতিত্ব হরণের জন্যই আমাকে ওই এসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। সেই অতিরিক্ত সচিব মহোদয় এখন ওএসডি আর সম্পাদক মহোদয় জেলে!
আমি জানি, ক্যারিয়ারের এই সূচনাপর্বে সত্য প্রকাশে ঝুঁকি আছে। কিন্তু অন্তরে তো ধারণ করি রবীন্দ্রনাথের সত্য ও সুন্দরকে। ‘সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সে কখনো করে না বঞ্চনা’-সাশ্বত এ বাণী অন্তরে আমার-ভয় কীসে?
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
[email protected]
- মফস্বল সাংবাদিকতার জয় হবেই
- সেঁজুতি এবং গ্রামীণ সাংবাদিকতা
- সেঁজুতিকে ফেরানো গেলো না!
- সেঁজুতি যেতে চায়, যাক...
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১