বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় যে জাতির ভাষা আন্দোলনের দিনটি বিশ্বের প্রায় ৭,৮০০ ভাষার সংরক্ষণ ও প্রচলনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যথাক্রমে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ও ২০০৮ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে, সেখানে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ও অভিলাষ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে বাংলার স্থান রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই!
একমাত্র ইংরেজি ভাষায় সৃষ্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইট (www.pmo.gov.bd)-তে গেলে সেই সত্যটি জানা যায়। পাশাপাশি সেখানে প্রধানমন্ত্রীর জীবনবৃত্তান্তে দুটি লক্ষণীয় বিষয় নজর পড়বে।
এই ওয়েবসাইটটির হোমপেজে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আপনাকে স্বাগতম। আমরা আশা করছি, একজন নাগরিক হিসেবে কিংবা ঔৎসুক্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই সাইটের ব্যবহারকারীরা পরিবেশিত তথ্য ব্যবহার করতে পারবেন। এই সাইট কার্যালয়টির কাঠামোগত মৌলিক তথ্য, কর্মপ্রক্রিয়া এবং একইসাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিবিধ মন্ত্রণালয়ের সংযোগটি প্রদান করেছে। এই সাইট আপনাকে বুঝতে সক্ষম করবে বাংলাদেশে সরকার কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং একইসাথে বিশ্বের প্রতি অঙ্গীকার পরিপূরণ হচ্ছে। আমরা আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ প্রত্যাশা করছি’।
এতে ‘অ্যাবাউট পিএমও’ বাটনে সংযুক্ত আছে তিনটি ভিন্ন পাতা- সার্ভিসেস অ্যান্ড অ্যাক্টিভিটিজ, প্রাইম মিনিস্টার্স বায়োগ্রাফি ও কি পারসোনেল। সার্ভিসেস অ্যান্ড অ্যাক্টিভিটিজে মোট ২২ ধরণের সেবা ও কর্মতৎপরতার কথা বলা হয়েছে। আর শেষোক্ত কি পারসোনেল তালিকায় শতাধিক ব্যক্তির নাম ও পদবী সম্বলিত ফোন নম্বর রয়েছে।
তবে এটির মধ্যবর্তী পাতা যেখানে প্রাইম মিনিস্টার্স বায়োগ্রাফি বা জীবনবৃত্তান্ত রয়েছে, সেটির অন্ততঃ দুটি বিষয় নজর এড়িয়ে যাবার নয়। এটির তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ÔFather of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman along with the members of his family was martyred on the fateful night of 15 August 1975. Sheikh Hasina and her younger sister Sheikh Rehana were the only survivors as they were in West Germany at that time. Later she went to the United Kingdom from where she started her movement against the autocratic rule in 1980. Sheikh Hasina was unanimously elected President of Bangladesh Awami League in 1981 in her absence, while she was forced to live in exile in New Delhi. Ending six years in exile, she returned home finally on 17 May 1981.’ অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। সে সময় শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা জার্মানি থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। পরে সেখান থেকে তিনি যুক্তরাজ্য যান, যেখান থেকে তিনি ১৯৮০ সালে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ আওযামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন, যে সময়ে তিনি নয়া দিল্লি¬তে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছয় বছরের নির্বাসন জীবন ঘুচিয়ে তিনি দেশে ফেরেন।
এখানে তার এই ‘ছয় বছরের নির্বাসন’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কী তিনি একাধারে যুগপৎ যুক্তরাজ্য ও ভারতে নির্বাসনে ছিলেন, নাকি কেবল ভারত থেকেই তিনি ‘১৯৮০ সালে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করেন’।
অন্যদিকে, এই জীবনবৃত্তান্তের ষষ্ঠ প্যারায় যে বিষয়টির বর্ণনা আছে, সেটি বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে সর্বাধিক আলোচিত একটি বিষয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত। সেখানে বলা হয়েছে, `Sheikh Hasina created awareness among the people and waged a struggle for Non-party Caretaker Government to ensure free and fair polls. Her movement reached the peak after a non-cooperation movement in March 1996 and the provision for Non-party Caretaker Government was incorporated in the Constitution. অর্থাৎ শেখ হাসিনা জনতার মাঝে সচেতনতা সঞ্চার করেছেন এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জাগিয়ে তোলেন। ১৯৯৬ সালের মার্চে অসহযোগিতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং এর ফলস্বরূপ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।
অথচ আপাতদৃষ্টিতে, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেটি-ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রারম্ভিক রূপরেখা প্রণয়ন করে।
জাতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সহসাই কি জানবে, আসলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃতিত্ব কার? যেহেতু সেটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হিসেবে জীবনবৃত্তান্তে স্থান পেয়েছে, তা হলে কেন তার দল আজ সেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রবর্তক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি উৎপাটন করেছে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই কৃতিত্ব দাবি কি সমীচীন হয়েছে? একই সাথে গত পৌনে তিন বছরে তার দল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পরিপূরণের অভিলাষ প্রদর্শন করলেও কেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটটি আজও বাংলায় করেনি?
ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৩১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১১