তবে আমের আদি যাই হোক না কেন, আম তার স্বমহিমায়ই নিজেকে বিকশিত করেছে, তার আপন রস মানে আমরস পৃথিবীর মানুব কূলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে ঢেলে দিয়েছে। শুধু মানুষের জন্যই নয়, পৃথিবীর সব বাদুরকূল, পক্ষীকূল ও মাছিকূলের জন্য নিজেকে সে উজার করে দিয়েছে।
বড়-বড় আকারের মাছি কোথা থেকে এসে মানুষের সঙ্গে-সঙ্গে নিজেদেরও আমরসে ভাসিয়ে দেয় তা এক অবাক বিস্ময়! ওই সব বড়বড় মাছির আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে বঙ্গ-সমাজে নানা কথা প্রচলিত আছে।
এই বঙ্গভূমিতে কবে কোথায় প্রথম আমাগমন হয় তা আমাদের জানা নেই। তবে একথা অনুমান করা চলে যে এটি বঙ্গভূমির অতি প্রাচীন একটি ফলই হবে। এই বঙ্গসন্তানরা আমরসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে অতি যত্নের সঙ্গে এই বঙ্গভূমিতে আম গাছ রোপন করেছেন ও যত্ন-আত্তি করে বড় করেছেন।
আমের মতো অন্য কোনো ফল গাছ এতো সেবা-যত্ন প্রাপ্ত হয়ে এ বঙ্গভূমিতে ফুলেফেঁপে উঠতে পারেনি। শুধু তাই নয়, আম বাগানের অন্য কোনো ফলের বাগান এ অঞ্চলে আর নাই। বিশ্বাস-হইবেও না কোনোদিন।
এ বঙ্গভূমির আমের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস, যদিও তার শুরুটা ঠিক জানা যায় না। তবে চীনা পর্যটন হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে এ অঞ্চল এসেছিলেন। এ বিশ্ব পর্যটক বঙ্গভূমিতে এসে এর অনেক কিছুতেই তিনি বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অন্য কোনো ফলের নয়, এখানকার আমের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ও বিশ্ববাসীর কাছে এই আমের কথা প্রচার করেছেন।
মোগলরা আম বড় পছন্দ করতো। জানা যায়, সম্রাট আকবর ভারত ভূখণ্ডে লক্ষাধিক আমের চারা রোপণ করে এ উপমহাদেশে উন্নত জাতের আমের শুভ সূচনা করেন। হয়তো বা সেই থেকেই বৃহত্তর ভারতবর্ষে আম বাগানের শুরু। মোগলদের আমের এই ধারাবাহিকতা শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বাহাদুর শাহও আম পছন্দ করতেন। বিখ্যাত কবি মীর্জা গালিব ছিলেন বাহাদুর শাহর খুব প্রিয়পাত্র ও বন্ধু বৎসল। তারা দুজনে শাহী বাগানে ঘুরে ঘুরে আম পেড়ে খেতেন। শেষ জীবনে গালিব খুব কষ্টে জীবন-যাপন করেছেন। এদিকে বাহাদুর শাহও নজরবন্দী। গালিবের দুর্দশার কথা শুনে এর মধ্যেও বাদশাহ তার শাহী আম বাগান থেকে গালিবের জন্য আম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মোগলরা যে আম বাগানের শুরু করেছেন ভারতবর্ষে, সেই আম বাগান আজ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দিল্লির পথে প্রান্তরে শুধু একটি গাছই দৃশ্যমান- সেটি আম। কলকাতায়ও রয়েছে প্রচুর আম গাছ।
কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে গেলে রানাঘাট, তাহিরপুর ও কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর থেকেই চোখে পড়বে সারি সারি আমের বাগান। এর আগেও আছে। তবে কৃষ্ণনগর থেকে শুরু করে পলাশী, মুর্শিদাবাদ, মালদহ পুরোই আমের বাগান।
এই মালদহ থেকে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্ব। এরপরই রাজশাহী। তার মানে, আমাদের রাজশাহীর যে আম বাগান রয়েছে তার শুরু হয়েছে সেই কৃষ্ণনগর বা মালদহ-মুর্শিদাবাদে। এই পুরো অঞ্চলটাই আমের বাগানে পূর্ণ। মুর্শিদাবাদের আম বাগানের ইতিহাস ইতোপূর্বে বাংলানিউজে প্রকাশিত হয়েছে।
বলা হয়, পৃথিবীতে আছে ৩৫ ধরনের আম, আর মুর্শিদাবাদের কাঠগোলা বাগানেই রয়েছে ১২৬ প্রকার আম। আর পলাশীর আম্রকাননের কথা তো আমাদের সবারই জানা আছে।
ফলের রাজা ও রাজপুত্তুর দুই-ই আম। আমের রয়েছে কত জাত-প্রকার। এসব আমের আবার উপজাতও আছে। অনেক আমেরই রয়েছে আলাদা-আলাদা গল্প ও ইতিহাস। যেমন ফজলি আম। এটি ফকিরভোগ নামেও পরিচিত।
কথিত আছে, ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধার বাড়ি থেকে প্রথম এই আমের উৎপত্তি। তিনি থাকতেন গৌড়ে। বৃদ্ধার বাড়ির আঙিনায় ছিল একটি পুরনো আমগাছ। বৃদ্ধা ফকির-সন্ন্যাসীদের ওই আম দিয়ে আপ্যায়ন করাতেন।
শোনা যায়, ব্রিটিশ আমলে মালদহের কালেক্টরেট সাহেব পথিমধ্যে ওই ফজলি বিবির বাড়ির পাশে শিবির স্থাপন করেছিলেন। বৃদ্ধা তাকে ওই আম খাওয়ান। কালেক্টরেট সাহেব সেই আম খেয়ে যার পর নাই খুশি হয়ে ওই আমের নাম দিলেন ফজলি আম।
মোগলদের পরে পর্তুগিজরাও আমের প্রশংসা করে গেছেন। এরপর বৃটিশরা এসেছেন ও আমে মজে দুইশ’ বছর এখানে রাজত্ব করেছেন।
বঙ্গভূমির আমের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। সেই ইতিহাস এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমের রাজধানী রাজশাহীতে বাংলানিউজ আম নিয়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছে, যা সত্যি প্রথম ও ব্যতিক্রম এবং প্রশংসার দাবি রাখে।
আমের সম্ভাবনা ও সমস্যা এবং আমাদের জীবনে আম-এ নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উঠে এসেছে আমের আদ্যোপান্ত। আমের দেশে নতুন বেশে আমরা আমকে জানতে পেরেছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু মূল্যবান বক্তব্যে আম বিষয়ক এক ঐতিহাসিক তথ্য দিতে একেবারেই ভুল করেননি। তার মুখে শুনি-মহারানি ভিক্টোরিয়া আম খেতে চেয়েছিলেন।
রাজা-বাদশাহ বা মহারানি; যেই হোক-তিনি যদি আম না খেয়ে থাকেন তবে কী দাম আছে তার সেই বাদশাহীর! মহারানি ভিক্টোরিয়া বুদ্ধিমতি ছিলেন; পৃথিবীর অর্ধেক তিনি শাসন করেছেন। আমভোগ থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করতে চাননি।
এ বঙ্গভূমিতে সারা বছরই কত ফল আসে-যায়। কিন্তু আম নিয়ে আম জনতার আগ্রহের শেষ হয় না। এই বঙ্গভূমিতে আম ছাড়া ফলাহার হয় না। তেমনি জৈষ্ঠ্য মাস এলে জামাইকে আম না খাওয়ালে শ্বশুরের যে আর মান থাকে না!
আম আমাদের জীবনেরই অংশ। তাই আম নিয়ে কৌতুকেরও শেষ নেই।
যেমন-
কাকা: কিরে কেষ্ট তুই গাছে উঠে আম চুরি করছিস?
কেষ্ট: না কাকা, আম গুলা পইড়া গেছিল, আমি গাছের ডালের সাথে জোড়া লাগাইতেছি।
কাকা: চালাকি! তোর বাবাকে এখনই বলতেছি, ছেলেটাকে চোর বানিয়েছে।
কেষ্ট: বাবা তো পাশের গাছে আম জোড়া লাগাইতেছে, কাকা।
এদিকে বাদশাহ আকবর বীরবলকে খুব ভালবাসতেন৷ তিনি বীরবলকে আরো শাহী খানা খেতে বললেন। কিন্তু বীরবল বললেন, পেটে আর জায়গা নেই হুজুর৷ একটু পরে একজন এসে বীরবলের প্লেটে আম রাখল৷ বীরবল সব আম খেয়ে ফেললো। বাদশাহ তো খুব রেগে গেলেন।
বীরবল বাদশাহকে বললেন, হুজুর রাস্তায় যখন খুব ভিড় থাকে তখন সেই পথ দিয়ে আপনি গেলে সবাই সরে গিয়ে আপনাকে জায়গা করে দেন৷ আপনি যে রকম আমাদের রাজা, আমও সে রকম ফলের রাজা৷ আপনাকে যে রকম আমরা রাস্তায় ছেড়ে দিই৷ পেটও সেই রকম আমকে দেখে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে৷ তাই আমি আম খেতে পেরেছি৷
একদিন শিক্ষক বললেন, আমি ক্লাসে তোমাদের বলেছি, কখন আমের চারা লাগাতে হয়, কীভাবে তার যত্ন নিতে হয়। এবার বলো তো, কখন আম পাড়তে হয়? ছাত্রের উত্তর, আমগাছের মালিক ঘুমিয়ে থাকলে, স্যার।
মীর্জা গালিবের এক বন্ধু আম পছন্দ করে না। গালিব বললেন, আম খাওনা কেন? বন্ধু উত্তর দিলেন, আমি আম খাবো কেন? পাগলেও আম খায় না। গালিব বললেন, আরে পাগল বলেই তো আম খায় না। বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে আম খাওয়া শুরু করলেন।
এই বঙ্গভূমির পাগলেরাও আম খেতে ভুল করে না। তাই বঙ্গসন্তানদের জীবনে আমের চেয়ে বড় সত্য আর নাই। আমাদের কাছে আমই সত্য।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৮
এমএ/