ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ইস্! একটুর জন্য পুরোটাই মিস্!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১১
ইস্! একটুর জন্য পুরোটাই মিস্!

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন শেষ হবার পর শুরু হয়েছে কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেবার প্রতিযোগিতা। মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া দল তাদের প্রার্থীর ব্যাপক ভরাডুবি দেখে জনগণের বিজয় ছিনিয়ে নেবার জন্য বলা শুরু করেছে, আইভীর বিজয় দলের বিজয়।

ওদিকে বিএনপি যে আশায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, তৈমুরের ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ আর দলীয় বক্তব্যের মধ্যে ব্যপক ফারাক থাকায় সে আশায়ও গুড়ে বালি। কি মুশকিল!

পরিকল্পিতভাবে হোক আর কাকতলীয়ভাবে হোক, নির্বাচনের আগে আওয়ামিলীগের মধ্যে দুটো ভাগ হওয়ায় বেশ কাজে লেগেছে। নির্বাচনের আগে দলের একটা গ্রুপ বেশ সক্রিয় ছিল শামীমকে জেতানোর জন্য। অন্য গ্রুপটি ছিল এক রকম নিরব। আইভীর বিজয়ের বিধ্বংসী ছক্কা বলটি সেই শামীম ঘেঁসা সক্রিয় টিমটির মাথার উপর দিয়ে বো বো করে উড়ে যাওয়ায় পুরো টিমটাই ঠিক বাতাস পাওয়া মুড়ির মতো চুপসে গেছে। ওদিকে নিরব থাকা টিমটি আইভীর বিজয়কে পুঁজি করার জন্য কথার বেলুনে ধীরে ধীরে ফুঁ দিচ্ছে। এরই মধ্যে একটু একটু বলা শুরু করে দিয়েছে, আইভীর বিজয় আওয়ামিলীগের বিজয়। তাকে দল প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও বহিস্কারতো করেনি। এক্সকিউজ মি! মিথ্যা কথা বলবেন না। মিডিয়ার বদৌলতে সারা দেশের জনগণ জেনে গেছে এই বিজয় কার! এই বিজয় জনগণের! আর হার হয়েছে শুধু আওয়ামিলীগের নয়। পুরো ধসে যাওয়া রাজনীতির।

গোয়ার্তুমি রেখে একটু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেই নির্বাচনের ফল আওয়ামিলীগ তার ঘরেই তুলতে পারতো অনায়াসে। সেটা দিয়ে বেশ কয়েকদিন নৌকার পালে হাওয়া তুলে ফুরফুরে মেজাজে চলতে পারতো। আইভীকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামিলীগের যে চরম নৈতিক পরাজয় ঘটেছে সে কথা সারা দেশের যে কোন ‘ওয়া’ বলা শিশুও বলতে পারবে। আর সেনা মোতায়েন না করে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ক্ষুন্ন করে সেই ভুলের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকা হয়। আওয়ামী ঘরানার অনেক সাংবাদিক এবং কলাম লেখকরা এখন বলাবলি করছে, কৈ নির্বাচনে কোন গোলযোগ তো হয়নি। গোলযোগ হবে কি করে! গোলযোগের সেই মশল্লা বিরোধী দল, তো সেই ‘রাজনীতির উনোনে’ ’ভোটের পাতিলে’ নেই। মশলা ছাড়া খাবারের স্বাদ জমে ওঠেনা। ঠিক একইভাবে বিরোধী দল ছাড়া গোলযোগ জমবে কিভাবে? যুগে যুগে এসবে একপেষে কালি ধারনকারী সাংবাদিকেরা একটা বিপর্যয় শেষ হবার সাথে সাথে চাটুকারিতার মাধ্যমে দলের জন্য পরবর্তী বিপদের ক্ষেত্র তৈরী করে রাখে। এদের কারণেই দলের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ মাঠের সঠিক কারণ জানতে ব্যর্থ হয়। মাগুরা নির্বাচন নিয়ে বিরোধী ঘরানার সাংবাদিকদের একটা অংশ ঠিক একই কাজ করেছিল তখন।

যাইহোক, আমার ধারনা, শেষমেষ তৈমুর থাকলেও গোলযোগ হতো না। কারণ আইভী সুনামী তৈমুরকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেত। তাছাড়া ভবিশ্যতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মিডিয়া এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর একটা সতর্ক দৃষ্টি ছিল নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের উপরে। সেই বিবেচনায়, অনেক ভুল করলেও সরকার গোলযোগ করার সুযোগ দিয়ে এই ভুলটা হয়তো করতো না। মানুষ এখন যাই বলুক, উপরের দুটো চরম ভুল করায় যে সরকারী দলের মধ্যে এখন ভিষন আক্ষেপ কাজ করছে সেটা অনুমান করা যায়। নির্বাচনের ফল এখন দলের ‘খারই’ (গ্রামঞ্চলে মাছ ধরে সেটা রাখার বাশের তৈরী ছোট আধার) থেকে জনসমুদ্রে হারিয়ে গেল! ইস্! একটুর জন্য পুরোটাই মিস্!

নির্বাচনের পরপর যেটা ঘটে যে, এক পক্ষ বিজয়ের উল্লাসে উম্মাদ হয়ে যায় এবং অন্যপক্ষ, নির্বাচনে ‘পুকুর চুরি’, ‘নদী চুরি’, ‘সাগর চুরি’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ভোটাররা রাজনীতিবিদদের এমন শিক্ষাই দিয়েছে যে, উভয় পক্ষ কি বলবে সেটা ঠিক করতে কয়েকটা দিন লেগে যাচ্ছে। মার খেতে অভ্যস্ত জনতা এবার নেতাদের এমন মারফতী মার মেরে বসবে স্বপ্নেও হয়তো তারা ভাবেনি।

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে নিয়ে জনগণের সাহসী জবাবের অনেক বিশ্লেষণই অনেকে করেছেন। কিন্তু একটি ব্যপার নিরব থেকেছে সেখানে। সবাই জানেন যে, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের একটা পারিবারিক প্রভাব রয়েছে। জাতীয় রাজনীতির মতো আঞ্চলিক রাজনীতিতেও কোথাও কোথাও রয়েছে পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রভাব। সেই কারণে এরা জনগণের দাবি এবং মতামতকে তোয়াক্কা না করে এককভাবে স্বিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেনা। দলের সমর্থনে ওজন পাওয়া ওসমান পরিবারের সন্তান শামীমের লজ্জাজনক বিজয় কি দেশে উত্তারাধিকার রাজনীতির কবর রচনার ইঙ্গিত কিনা ভেবে দেখার বিষয়। এরকম কিছু হলে সেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটা ইতিবাচক ঘটনা।

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন থেকে প্রধান দুটি দল একটা শিক্ষা অন্তত পেয়েছে যে, দল থেকে সন্ত্রাসীকে মনোনয়ন আর ’না’। তৃণমূলকে অবজ্ঞা করে দল থেকে চাপিয়ে দেয়া স্বিদ্ধান্ত আর ’না’। আইভীকে মনোনয়ন না দিয়ে তৃণমূলের দাবিকে ঠেলে ফেলে আওয়ামিলীগ যে মহাভুল করেছে বিএনপিও সেই কাতারে সামিল হোল একেবারে শেষ পর্যায়ে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আইনগতভাবে দলীয় না হলেও দলীয় প্রভাব কাজ করে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সেখানকার মানুষের সাথে আলোচনা না করে, নির্বাচন বর্জনের সঠিক এবং যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা না করে, নির্বাচন থেকে সরে আসায় বিরোধী দল যে আম ছালা দুটোই হারালো আশা করি সেটা এখন বুঝতে পারবেন। যে উদ্দেশ্যে বিএনপি একেবারে শেষ মুহুর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালো তা স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় প্রার্থী এবং কর্মীদের কাছে পরিস্কার ছিল না। স্বিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল কিনা ভবিষ্যত বলে দেবে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা না করে স্বিদ্ধান্ত নেয়ায় হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন দল বলছে এক কথা, প্রার্থী বলছে আমি সব হারালাম। দলের স্বিদ্ধান্তের কাছে বলি হলাম। একই দলের দুই সুরে দুই গান শুনে জনগণ বিভ্রান্ত। নির্বাচন বর্জন করে বিরোধী দল আন্দোলনে যে ফায়দা নিতে চাচ্ছিল তৈমুরের আক্ষেপে আপাততঃ সেটা হচ্ছে না বলে মনে হয়। তৈমুরকে ম্যানেজ করে নিলে হয়তো এটা হতো না। বিরোধী দলের জন্যও তাই ইস্! একটুর জন্য পুরোটাই মিস্!
 
আ্ইভীর সামনে এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দল এবং জনগণকে মূল্যায়ন নিয়ে। নির্বাচনের আগে দল আইভীকে ত্যাগ করেছিল, জনগণ আইভীকে গ্রহণ করেছিল। দল আইভীর স্বার্থ দ্যাখেনি, জনগণ দেখেছিল। নির্বাচনে জিতে যাবার পরে দল এবং জনগণের মাঝে কোন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে আইভীর অবস্থান কোন পক্ষে যায় সেটাই দেখার বিষয়। ধীরে ধীরে দল এখন বিজয়ী আইভীকে কাছে টানতে চাইছে। এমনকি দু’দিন আগে ‘দৌড়’ দেবার হুমকি দেয়া প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

সাদা চোখে এ সব কিছুকেই সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু  আমাদের দেশে বিগত দিনের রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে সেরকম কিছু করা আরেকটা বোকামী বলেই মনে হয়। জানি দলবাজ অনেকেই বলবেন, এটা আমার অহেতুক সন্দেহবাতিকতা। কিন্তু যুগ যুগ ধরে যে সব রাজনীতিবিদরা তাদের কাজ এবং কথার দ্বারা জনগণের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছেন, জনগণকে ধোকা দিয়েছেন সেটা দূর করার দায়িত্ব প্রথমে কার? জনগণের? যারা বছরের পর বছর রাজনীতিবিদদের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করে ঠকেছে? নাকি সেই সব মিষ্টিভাসী রাজনীতিবিদদের, যারা বারবার জনগণকে প্রতারিত করেছে বিভিন্নভাবে? তাই প্রথমে তাদের কথা এবং কাজের মাঝের ফারাক দূর করে প্রমাণ করতে হবে ‘সাচ্চা’ হিসেবে।
 
আবারো বলবো, আইভীকে ভুলে গেলে চলবে না যে, দল তাকে কাছে না টেনে পুরস্কৃত করেছিল একজন সন্ত্রাসীকে। বিপদে দলের কেউ আপনার পাশে ছিল না। সন্ত্রাসী রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে লাখো জনগণ নির্বাচনী ঝড়ের উত্তাল হাওয়া থেকে আপনাকে আগলে রেখেছিল। সাফল্য এখন আপনার হাতের মুঠোয়। এবার দেখবো আপনার কাছে কে বড়? দল না জনগণ? আইভীর মতো ভাল মানুষের কাছ থেকে আমরা ভালটাই আশা করবো। তার সামনে জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আছে। যার বিরুদ্ধে আইভী ব্যাপক ভোটে জিতেছে দলের দুঃসময়ে দল, কর্মী এবং জনগণকে রেখে পালিয়ে যাওয়াতে ভোটও এবার পালিয়েছে তার মার্কার কাছ থেকে। ভবিষ্যতে যে কেউ জনগণকে রেখে দলীয় আনুগত্য কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে পালানোর চেষ্টা করলে একই পরিণতি হবে।

একটা চুটকি দিয়ে শেষ করবো লেখাটা। ’সুনামি নেত্রী’ আইভীকে উদ্দেশ্য করে লিখা। উনি লেখাটা পড়বেন কিনা জানি না। তবে পড়লে ওনার মতো সজ্জন ব্যক্তি এই অখ্যাত ব্যক্তির অনুরোধটা মনে রাখবেন বলে বিশ্বাস আছে। বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া এই চুটকিটা দিয়ে ১৯৮৯ সালে একটা স্থানীয় পত্রিকায় লিখেছিলাম সেখানকার নির্বাচনকে উদ্দেশ্য করে। নির্বাচনের প্রার্থী ভোটের আগে বাড়ীতে কেউ এলেই পিপাসা মেটাতে পানির বদলে কোকের বোতল খুলে দিত। বোতল খোলার সেই ফস্ (গ্যাস বেড়িয়ে যাবার) আওয়াজের টানে নাকি বিনে পয়সায় কোকের মজা নিতে জানি না, ভোটের শেষে এক বুড়ো লোক আবারও এলেন সেই প্রার্থীর বাসায়। এবার পানি চাইতেই এলো টেপের খাটি পানি। বোতলের পানি চাইলে প্রার্থীর এক চামচা ঝামটা মেরে বললো, ভোট শেষ। এখন  আর ফস্ করে না। খাইলে খাও, না খাইলে যাও।
 
আশা করি, গণ বিপ্লবের জনগণের আই (চোখ) জনগণের ভোট পেয়ে তাদেরসাথে সেই বেঈমানীটা করবেন না। জনগণের দৃষ্টিতে আইভী এখন শুধু মেয়র নন, তিনি তাদের স্বপ্নের ফসল। সেই স্বপ্ন রাজনীতিতে টপ ডাউন স্বিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাঠের মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান দেখানোর স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন জনগণের ইচ্ছা পূরনের স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন নেতা ও জনগণের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচানোর স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরনের দায়িত্ব এখন জনগণের ‘দৃষ্টির বিজয়ের’ উপরে গিয়ে পড়েছে। ’আই’ হচ্ছে চোখ বা দৃষ্টি এবং ইংরেজী ‘ভি’ হচ্ছে বিজয়ের প্রতীক। আইভী, তুমি এখন ‘দৃষ্টি বিজয়িনী’। জনগণের দৃষ্টি পড়েছে তোমার দিকে। বিজয় হয়েছে তোমার, বিজয় হয়েছে জনগণের। জনগণ তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছে, এবার তোমার দায়িত্ব জনগণের স্বপ্ন পূরণের।

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১১৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।