ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

খোকনকে মুক্তি দিন আগে

ফজলুল বারী কন্ট্রিবিউটিংএডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১১
খোকনকে মুক্তি দিন আগে

নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকান্ড নিয়ে আবার প্রকাশ ঘটল শাসক দলের অভ্যন্তরীন বিশৃংখলার। নারায়নগঞ্জের ক্ষত না যেতে এ আরেক ক্ষত।

রক্তাক্ত ক্ষত! অভিযোগ যেখানে সরকারি দলের অভ্যন্তরীন বিশৃংখলা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়িয়েছে! জনগনের বিপুল ভোট নিয়ে ক্ষমতায় বসা দলটি এরমাঝে এতই লাগামছাড়া বিশৃংখল যে একজন পৌর মেয়র হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে ঈদের আগ মুহুর্তে স্থানীয় ছাত্রলীগ সেখানে কান্ডজ্ঞানহীন ৭২ ঘন্টার হরতালই শুধু ডাকা নয়, জ্বালিয়ে দিয়েছে আস্ত একটা ট্রেন! নিহত লোকমানের জানাজার জন্য হরতাল প্রত্যাহার হলেও গরিব জনগনের টাকায় কেনা একটি ট্রেন যে ধবংস হলো, এর দায় কে নেবে? এখন পর্যন্ত তুখোড়(!) সব সরকারি নেতারা এসব নিয়ে অবাক নিরব!

ট্রেন পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু এত বাগ্মী স্বরাষ্ট্রমনত্রী সাহারা খাতুন যিনি গরুর বাজার দেখারও সময় পান, এত বড় ঘটনার পর একবার নরসিংদী যাবারও দরকার মনে করলেন না! যেন এমন দু’এ্কটি ট্রেন তার বা তাদের কাছে কিছুই না! খুনের নেপথ্যে সন্দেহ যার দিকে সেই মনত্রী রাজিউদ্দিন রাজু এরমাঝে প্রধানমনত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। অতএব পুলিশও যেন পেয়ে গেল তদন্তের গাইড লাইন! কারন ওই পুলিশ অফিসারদেরও ঘাড়ে একটা করে মাথা! একাধিক মাথাওয়ালা পুলিশ বাংলাদেশে নেই বা কোথাও থাকেনা।

নরসিংদীর ঘটনার আগে নারায়নগঞ্জে শাসকদলের যে বিশৃংখলা-ড্যাম কেয়ার ভাব দেশের  মানুষ দেখল তা অনেকদূর যাবে মনে হচ্ছে। কারন কোথাও কোন ভুল স্বীকার বা সংশোধনের লক্ষনও নেই!  উল্টো আছে আস্কারা! যেন উনারা পয়গম্বর! কোথাও কোন ভুল করেননা বা ভুল বলে কোন উনাদের অভিধানে নেই! হামবড়া ভাব নিয়ে তৃণমূলের কাছে জনপ্রিয় প্রার্থী আইভিকে নারায়নগঞ্জে উনারা নমিনেশন দেননি! নির্বাচন কমিশনের সার্বভৌম কর্তৃ্ত্বের অধীনে উনারা নির্বাচনের  বলেন। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকে সত্ত্বেও সেখানে সেনাবাহিনী দিলেন না! এরপর প্রধানমনত্রীর জবানিতে এ নিয়ে যে সব কথাবার্তা এসেছে তা আরও ভয়ংকর!

প্রতিরক্ষা মনত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমনত্রী বললেন,তিনি ঠিক করবেন সেনাবাহিনী কখন ব্যারাকের বাইরে যাবে না যাবে। নির্বাচন কমিশন না! এখানে যুদ্ধের কথাতো হচ্ছেনা! তাহলে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়াই কেন মেডিক্যাল কলেজের কর্তত্ব থেকে শুরু করে দেশের আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে রাখা হয়েছে? নারায়নগঞ্জে সেনাবাহিনী দিয়ে দিলে কী অশুদ্ধ হয়ে যেত মহাভারত? আওয়ামী লীগের মতো ভীষন খুব সুরত চরিত্রের(!) এক প্রার্থীর কারনে এই নির্বাচনেতো বিএনপির কোন সম্ভবনাই ছিল না। সে কারনে মানইজ্জত রাখতে তারা সেনাবাহিনীর অজুহাত দেখিয়ে আগেভাগে নির্বাচন থেকে সটকে পড়ে। এরপর প্রধানমনত্রীর ভাষার ‘আমরা-আমরাই’ তথা আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রাখতে কী সমস্যা ছিল? ভোটের দুপুরে একটু তেড়িবেড়ি ভাব দেখে শামীম ওসমানকে কী র্যাব দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসা হয়নি?

পাশের দেশ ভারতেও কেয়ারটেকার ব্যবস্থা নেই। ইমিডিয়েট পাস্ট সরকার নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তি সরকার হিসাবে কাজ করে। কিন্তু ভারতের নির্বাচন কমিশন কী করে না করে, পলিটিক্যাল পার্টি, প্রতিদ্বন্দ্বিরা কি রকম বাঘের মতো তাদের ভয় পায়, বিনা প্রশ্নে মেনে চলে তার খবরও নিশ্চয় সরকারি নেতাদের কাছে আছে। বাংলাদেশেও অনির্দিস্টকাল একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলতে পারেনা। কিন্তু নারায়নগঞ্জে নির্বাচন কমিশনকে হতভম্ভ করার যে দৃষ্টান্তটি রাখা হলো, এর জের অনেকদূর যাবে। সেখানে কোন গোলমাল হয়নি ঠিক, কিন্তু আইভীর ‘জনগনই আমার সেনাবাহিনী’ ঘোষনার পর  পাবলিক যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে যে বার্তাটি দিলো, তাতেও কারও হুশ হলোনা! তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনকে কী আরও জোরাল করে দিল না নারায়নগঞ্জের অভিজ্ঞতা?

সেখানে ভোটের বিকেলে ‘এমন জানলে নির্বাচনে অংশ নিতাম না’  বলা শামীম ওসমান পরে প্রধানমনত্রীর বার্তা পেয়ে তার সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। এরপর দু’জনকে ডেকে বিজয়িনী আইভিকে প্রত্যাখ্যাত শামীমের সঙ্গে মিলে মিশে চলতে বলে দেন প্রধানমনত্রী । এরপর কী করলেন শামীম ওসমান? বিডিআরের ঘটনার পর ক্যান্টনমেন্টে প্রধানমনত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পাচার হওয়া ভিডিও দেখে শিষ্টাচার লংঘনকারী সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ভিডিওটিতো এরমাঝে ছড়িয়ে গেছে অনলাইনের সবখানে। আগামী নির্বাচনে এটি বিএনপিওয়ালাদের বড় অস্ত্র হবে। যেখানে শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো শোনার-দেখার পর কী দলটির চেইন অব কমান্ডের ইজ্জত-অস্তিত্ব কিছুই অবশিষ্ট থাকে কী?

এখন যে জনগন এমন একটি ভিডিও দেখল শুনল, এমন সব কাঁচা ভাষা জানার-শোনার পর কী তাদের মধ্যে নারায়নগঞ্জ নিয়ে খুব বেশি আশা করার থাকবে? এ বি এম মুসা কে তা শামীম ওসমান জানেন না? আব্দুল গাফফার চৌধুরী কি লিখেছিলেন নির্বাচনের আগে? এরা কারা? না এরা বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী? মানবজমিনের রিপোর্টে এসেছে, এমন একটি নির্বাচনের পরও কেউ বসে নেই। নারায়নগঞ্জে এবারের কোরবানি ঈদের গরুর হাটগুলোও নামে-বেনামে হাতিয়েছেন দুইভাই শামীম ওসমান-নাসিম ওসমান! ভোটের পর পরাজিত শামীম ওসমান সেখানে সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় তার এমপি ভাইর কর্তৃ্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। প্রথমেই নিয়ে গেলেন গরুর বাজার! এসব কী চেঞ্জ ইমেজ শ্লোগানের সমার্থক? নাউজুবিল্লাহ!

নরসিংদীর লোকমান হত্যার পর জেলার মনত্রীকে কেন্দ্র করে শাসকদলের দীর্ঘদিনের আন্তঃকোন্দল উৎকট বেরিয়েছে। নিহতের পরিবারের পক্ষে দায়েরকৃত মামলাতেও যাদের আসামি করা হয়েছে সেখানে মনত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ভাই বাচ্চু সহ একজন বাদে সবাই আওয়ামী লীগের। আর পুলিশি বুদ্ধিতে শুরুতেই কিনা ৫৪ ধারার মামলায় গ্রেফতার করা হলো বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে! এর আগে এমন আরেকটি মামলায় ড্যাবের ডা জাহিদকে আটকের পর লোক হাসানো বেশি জমার আগেই তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এসব পাগলামোতে একটি নির্বাচিত সরকারের ইমেজ বাড়ে না কমে?

খায়রুল কবির খোকন কে তা শেখ হাসিনা বা শাসকদলের নেতারা জানেন না? বিএনপিতে যে কিছু তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের নেতা আছেন, তাদের একজন খোকন, তাই নয় কি? নব্বুইয়ে এরশাদকে উৎখাতের সময় তিনি ডাকসুর জিএস। সেই প্যানেলের আমান উল্লাহ আমান, নাজিম উদ্দিন আলমদের চেয়ে ভিন্ন ইমেজের খোকনকেতো সাবেক ছাত্রলীগ নেতারাও ভালো চেনেন জানেন। এখন আপনার হাতে ক্ষমতা বা পুলিশ আছে বলেই একটি খুনের ঘটনার পর আপনি যাকে তাকে ধরে হয়রানি করবেন, এটা কী ধরনের কথা? এসব ক্ষমতা বা পুলিশি দাপট কী চিরস্থায়ী? এমন যদি হয় তাহলেতো খোকনকে না আগে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা দরকার ছিল! কারন খোকনের নেত্রীতো খালেদা জিয়া। লোকমানকে তিনি খুন করিয়ে থাকলেতো হুকুমের আসামি খালেদা জিয়ারই হওয়ার কথা! ক্ষমতার মুরোদ দেখাতে চাইলে হাই প্রোফাইলিটি মেনটেন করা উচিত নয় কী? সরি!
মজার ব্যাপার যে লোকমানের পরিবার বা কেউ কিন্তু খোকন বা বিএনপির তো কারও নাম মুখেও আনছেনা! আনল পুলিশ! ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ! তারপরও আবার ৫৪ ধারায়! নরসিংদীতে যাদের নামে মামলা হলো, যাদের দিকে সন্দেহের তীর তাদের কাউকে ধরেন না বা ধরতে পারেন না, একজন খোকনকে ঢাকায় হাতে কাছে পেয়ে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সুনির্দিষ্ট মামলা ছাড়াই আটকে রাখবেন, এটি কী ধরনের সুশাসনের দৃষ্টান্ত? আল্লাহর ওয়াস্তে আরও লোক হাসানোর আগে খোকনকে সম্মানের সঙ্গে মুক্তি দিন আগে। নরসিংদীর আপনাদের ঘরের ঝামেলা আপনারা মিটান। নারায়নগঞ্জে একজন জনপ্রিয় আইভি হাতে থাকতে তাকে নমিনেশন দেয়া হয়নি। নরসিংদীর জনপ্রিয় একজন লোকমানকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর সরকারি দলের হাতে পুড়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ একটি ট্রেন। এরপর আবার মনত্রীর ভাইকে আসামি করার শাস্তি হিসাবে সরকারি দল যে তাদেরি জনপ্রিয় নিহত মেয়রের শোকাহত পরিবারকে এখন পর্যন্ত কী রকম নির্দয় চলল, তাও একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।