হালে বেশ কদিন ধরে গালাগাল খাচ্ছি। অশ্রাব্য ও ছাপার অনুপযোগী সব ‘মারফতি’গালি।
ধর্মের সাথে ধর্মপ্রাণ আমার কোনো বিরোধ নেই। ধর্মীয় দায়িত্বেই একমাত্র সন্তানকে প্রতি শনিবার কোরান শিক্ষার স্কুলে পাঠাই নামাজ-কালাম-কলেমা শেখার জন্যে। দাদার মুরীদেরা প্রতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর ওরশ মাহফিলের আয়োজন করেন। পরিবারের কেউ না কেউ ডিসেম্বরের ’আগুনে’ ভাড়ায় দেশে আসেন। ‘লাভজনক’ পীরত্ব আমরা তিন ভাই ‘কনটিনিউ’ করিনি। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমার বিধবা মা পেনশনের টাকা জমিয়ে প্রতিবছর সুইডেন থেকে দেশে ফিরতেন শশুরের ওরশে শরিক হতে। পীরত্বে আস্হাহীন আমরা বাবা-মায়ের কবর জেয়ারতের নিয়ত পূরণে প্রতি বছর প্রায় হাজার দশেক ডলারের ধাক্কা লাগিয়ে সপরিবারে দেশে ফিরি। অথচ দেশে আমাদের কেউ নেই!
দাদার ওরশে খতমে কোরান ও বড় খতমে মাদ্রাসার ছাত্র ও নব্য আলেমদের একাট্টা করা হয়। অভিযোগ শুনি, আমন্ত্রিত তালেবে ইলেমরা নাকি ফাঁকি দেন। দশ পারা কোরান পড়ে তিরিশ পারার হিসাব দেন। একারণেই গেল কয়েক বছর ধরে একজন ‘সুপারভাইজার’ নিয়োগ দিচ্ছেন মুরীদেরা।
প্রায় তিরিশ বছর আগে, মোনাজাতের পর সিগ্রেট ধরিয়েছি মাত্র। এক ‘বাচ্চা’ আলেম পান চিবুতে চিবুতে বল্লেন, ‘ভাইজান, সিগ্রেট খাচ্ছেন গুনাহ হবে’। কোনো কারণে মেজাজটা খাট্টা ছিলো। প্রত্যুত্তরে বললাম, ‘আমার সিগ্রেটের নেশা। আর তোমার নেশা কড়া নূরানী জর্দ্দার পান। গুনাহ হলে দু’জনেরই হবে’। তালেবে ইলমের পাল্টা উত্তরে মুহূর্তেই চান্দি গরম। ‘ভাইজান পান খাওয়া সুন্নত’। ব্যাটাকে কষে থাপড় লাগানোর বাইরে কিছুই মাথায় আসেনি।
আমি এই ধাঁচের ধর্মান্ধতার বিপক্ষে। শরিয়তি আইনকে ইসলামী আইন দাবিদারদের বিরুদ্ধে। সমাজতন্ত্রের কার্যকর ব্যর্থতায় রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতির অন্যতম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি দুটোই জনপ্রিয়। শরীয়াহ আইন এই ধরনের একটি পদ্ধতি যার উদ্ভব শাসক মুসলমানদের স্বর্ণযুগে । কোরান-হাদিসের আলোকে একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের দাসপ্রথাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্হার প্রয়োজন মোতাবেক শরীয়া আইন প্রণয়ন ও চালু হয়। এই আধুনিক জমানায় দশ হাজার মাইল দূরে সেই আইনের বাস্তব বিবর্জিত প্রয়োগের বিরুদ্ধাচরণের সংগে ধর্ম ও ধর্মহীনতার কোনো সংশ্রব নেই।
দেশে হাফ প্যান্টপরা নাবালক ফেরিওয়ালার জবাইকৃত মুরগী খেলেও বিদেশে হালাল মুরগী নাহলে সামাজিক নিস্তার নেই। গোটা পাঁচেক পেগ ব্ল্যাক লেভেল সাবাড় করে মাতাল ‘মুসলমান’ মেহমানরা হালাল জবাই খোঁজেন। আর হালাল মুরগীর নামে চর্বি সর্বস্ব ‘বৃদ্ধ ও বাতিল’মুরগী কিনি। পাঁচ কেজিতে আড়াই কেজি ভারী মোটা চামড়া ও চর্বি যেন ভালো জাতের মুরগির হালাল জবাই নিষিদ্ধ! দামও আকাশ ছোঁয়া! অথচ ’বিনা হালালের’ মুরগীগুলো কচি ও দামে সস্তা। গরু-খাসী ও ভেড়ার মাংসের কেচ্ছা-কাহিনী এক। বেশি দামে খারাপ পণ্যই যেন হালাল দোকানের বৈশিষ্ট্য। প্র্যাকটিসিং মুসলমান হওয়াই যেন আজন্ম পাপ! ইসলামের নামে হালাল মাংস ব্যবসায়ীদের এইসব অনৈসলামিক প্রতারণার বিরুদ্ধেই আমার নিষ্ফল চিৎকার!
ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, আমার প্রতিবাদ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় আলখাল্লাধারী সমকামীর বিরুদ্ধে। এদের কারণে সমকামিতা ও ধর্ষণের আধার হয়ে উঠৈছে কতিপয় এতিমখানা, মাদ্রাসা আর মক্তব। ধর্মের নৈতিক শিক্ষা যাদের হাতে শুরু হবার কথা তারাই রাতের আঁধারে রক্ষক হবার বদলে ভক্ষক হয়! আমার ঘৃণা তাদের প্রতি। কিছু জোব্বাধারীর মনে বিন্দুমাত্র আল্লাহ ভীতি নেই। আল্লাহ’র ঘরকে অপবিত্র করতে ওদের বুক কাঁপে না। আমার রাগ ও উষ্মা এদের প্রতি। ধর্মের নামে, হাদিস-কোরানের ভুল ব্যাখ্যায় যারা এতিম মাসুম বাচ্চাদের হাতে জেহাদের নামে প্রতিহিংসার অস্ত্র তুলে দেয়, আমি তাদের বিপক্ষে দাঁড়ানো শব্দ সৈনিক।
ভন্ড, ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদেরদের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ নয়। এর মানে ধর্মীয় জেহাদ। আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হবে কী অসামান্য কারণে অজপাড়া গাঁর বকলম স্বঘোষিত পীর নামের আগে-পিছে হযরতের মতো সম্মানী জুড়ে দেবার দুঃসাহস করে? মাদ্রাসার সামান্য একটা পাশ দিয়ে আল্লামা ও মুফতী তকমা লাগায়? এইসব স্বঘোষিত পীর ও আল্লামা-মুফতীদের বিপক্ষে গেলে আমি কেন মুরতাদ বা কাফের হবো? ইসলাম কী এতোই ঠুনকো কোনো ধর্ম?
আসুন, ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা ইসলামের মহান নির্দেশগুলো হাফ-জ্ঞানী ’’আলেম-ওলামাদের’বাদ দিয়ে নিজ থেকে মানি। নারী নেতৃত্ব হারাম ফতোয়া দিয়ে নারীর নেতৃত্বে ঠাঁই নেওয়াদের প্রত্যাখান করি। কোরান ও সুন্নাহ’র শাসন ব্যবস্হা কায়েমের দাবীদারদের অনেকের সন্তানেরা আজ পশ্চিমা শিক্ষার ব্যারিস্টার। আল্লাহ’র আইন প্রতিষ্ঠায় বার-এট-ল’কী লাগে? আমার প্রতিবাদ এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডদের বিরুদ্ধে।
আমার জিজ্ঞাসা কেন মসজিদের মোয়াজ্জেন ও ইমামকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির স্বপক্ষে যেতে হবে? কেন তারা রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকবেন? তবে কী আজকাল দুনিয়াবি স্বার্থের কাছে আল্লাহর ভীতি পরাজিত?
পাদটীকাঃ প্রবাসী বাংগালী মুসলমান ভাইয়েরা আগে কোরবানীর জন্যে, হালাল মাংসের জন্যে দারস্হ হতেন টার্কিশ, লেবানিজ ও পাকিদের মাংসের দোকানের। হালে বাংগালী ভাইয়েরাও হালাল মাংসের দোকান খুলেছেন দেশীয় গ্রোসারির পাশাপাশি। গেল কয়েক বছর ধরে বাংগালীরা বাংগালী মাংসের দোকানের মাধ্যমে কোরবানির আয়োজন করে আসছেন। এবার আমার এক অধ্যাপক বন্ধু এধরণের এক বাংগালী দোকানের মাধ্যমে ছাগল কোরবানীর ব্যবস্হা করেছিলেন। একশ’ ডলারের কোরবানিতে বেচারা বন্ধু পেয়েছেন মাত্র সাড়ে ছয় কেজি মাংস। লেবানিজ দোকানে কোরবানীর ব্যবস্হায় থাকারা পেয়েছেন চৌদ্দ থেকে সতেরো কেজি। বাংগালী মুসলমানের দোকানের কোরবানীর মাংস অর্ধেকই গায়েব! গুজব মাংসগুলো দোকান মালিকের হালাল মাংসের দোকানে বিক্রী হবে। ওদের বুক কী একবারো আল্লাহর ভয়ে ভীত হয় না? প্রতিবাদ জানানোটা কী অনৈসলামিক হবে?
ইমেলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১০১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১১