আজ একুশে ফেব্রুয়ারি- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মদন্তু ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি সেদিনের তরুণ যুবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক’ (ভাষাসৈনিক গাজীউল হক)। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি— সুদীর্ঘ এক হাজার ৬৩৫ দিন পরও এই ঘোষণা অমর হয়ে ওঠে বাঙালির ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের মাধ্যমে।
১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ। সেখানে জিন্নাহ ঘোষণা করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয় (“Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language.”)। তিনি বজ্রকঠিন কণ্ঠে ঘোষণা করেন– কেউ যদি এই ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে তাকে পাকিস্তানের শত্রু বলে চিহ্নিত করা হবে (“Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan.”)।
১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আবারও একই ঘোষণা দেন পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ। এবারও তিনি বলেন যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে যারা দাবি করবে তারা পাকিস্তানের শত্রু। কিন্তু এবার দিগ্বিদিক বিদীর্ণ করে ছাত্রদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ উঠলো, ‘না, না, না’।
ছাত্রদের সেই প্রতিবাদের ঝড় কাঁপালো পুরো বাংলাকে। ভাষা যে কতটা ভালোবাসার, কতটা প্রাণের, কতটা আত্মার হতে পারে তার নিদর্শন একমাত্র বাঙালি জাতিই দিতে পারে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি’তে জীবন বাজি রেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো বাংলার জনগণ -
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পড়ায় আমাদের-ই হাতে পায়।
...
সইমু না আর সইমু না, অন্য কথা কইমু না
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান
এই জানের বদল রাখুম রে ভাই, বাপ-দাদার জবানের মান। ’
ওদিকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদল মরিয়া হয়ে উঠলো। বাঙালিকে দমন করতেই হবে। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়ে। চললো নিপীড়ন, নির্যাতন– কণ্ঠরোধের নতুন কৌশল– ভাষার বদলে ভাষা নয়; শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিশব্দ নয়- বুলেটই তাদের শক্তি।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলো ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি’তে। লাঠিয়াল পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালালো। আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম, রফিকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবার বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে।
ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তখন থেকে আজ অবধি প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলাদেশে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক, ঢাকারবিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। করুণ সুরে বাঙালি গেয়ে ওঠে,
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?’
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি— সুদীর্ঘ ১৯ বছর। বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে। ’ বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা দেন অখণ্ড পাকিস্তানে ওপর দাঁড়িয়ে।
যখন আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেলাম এক মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে, এক নতুন সংবিধান পেলাম স্বাধীন রাষ্ট্রের, তখন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গৃহীত সংবিধানে আমরা একই রকম দ্যোতনা দেখতে পেয়েছি। বাংলা ভাষায় রচিত পৃথিবীর একমাত্র সংবিধান হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ লেখা হলো, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।
অমর সাহিত্যবিশারদ মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন, ‘মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই সে মানুষ নহে। ’ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। পৃথিবীতে আর কোনো জাতিকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে হয়নি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করে। সদস্যপদ লাভের পর ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখার গৌরব অর্জন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু চমৎকার ইংরেজি ভাষা জানতেন। কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধু বিশ্বের দরবারে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। একজন বাঙালি হিসেবে এর চেয়ে গৌরবের আর কি হতে পারে? বাঙালি জাতির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পন্থা তো তার কাছ থেকেই শেখা। তার মতো আজ আমিও বলতে চাই—‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। ’ আর বলতে চাই, ‘অ’, ‘আ’, ‘ক’, ‘খ’ – আমার ভীষণ ভালোবাসার বর্ণমালা!
তুরিন আফরোজ
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ০৯০২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
এএ