অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড কিছুদিন আগে কার্বন ট্যাক্স চালুর প্রস্তাব দিতে গিয়ে বলেছিলেন, `লিডারশিপ মিনস মাউথ সাট অ্যান্ড মাইন্ড ওপেন’। অর্থাৎ খাঁটি নেতৃত্ব বাক্যবাগীশ না হয়ে চিন্তা-চেতনায় হবেন সুদূর প্রসারী।
ওয়ান ইলেভেনের সুবিশাল ‘রাজনৈতিক ধাক্কায়’ কুপোকাৎ ’শারীরিকভাবে’ মারাত্মক ‘অসুস্হ’ ও আর্থিকভাবে হঠাৎ গজিয়ে উঠা বিত্তশালী রাজনৈতিক ‘ধোয়া তুলসীপাতারা’ কিছুদিন বেশ বিপাকেই ছিলেন। ‘গাধার’ গুলিয়ে পানি খাবার প্রবণতা আক্রান্ত ওয়ান ইলেভেনের ’খাকী’ নেতৃত্ব শেষাবধি ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ । ওয়ান ইলেভেনের রণে ভঙ্গের সূত্রেই মাইনাস-ভীতির ছোঁয়াচে ‘রোগগুলো’ উল্টো ‘টু দ্য পাওয়ার টু’। সেই সূত্রেই আওয়ামী নেতৃত্ব এলেন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার চয়েসে। নিশ্চিন্তে ভোটের বাক্সে নিজেদের রায় ঢেলে `ম্যাংগো পিপলরা` (আমজনতা) সুন্দর আগামীর ডিজিটাল স্বপ্নে বিভোর হলেন। কিন্তু ক্ষমতার রাক্ষস ডিজিটাল-অ্যানালগ কিছুই বোঝে না। অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না। ফলাফলে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির আওয়ামী লীগ বছর না-ঘুরতেই রাবণ-তূল্য ‘দানব’। ধরাকে সরা জ্ঞান করা আওয়ামী নেতৃত্ব পুরনো সরকারের ফেলে আসা রাস্তাগুলোতে দিব্যি হাঁটাচলা শুরু করলেন। লাগামহীন হলেন ‘বাতচিতে’। আচার-আচরণের ঔদ্ধত্যের বয়ান লিখলে একটা গোটা মহাকাব্য হয়ে যাবে।
দলীয় রাজনীতির একক ও নিরংকুশ নেতৃত্বের কারণে গণতান্ত্রিক সরকার রূপ নিলেন নির্বাচিত স্বৈরাচারে। পারিবারিক বৃত্তে আবারো সীমাবদ্ধ হলো দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। যেন পরিবার আর পরিচিতির বাইরে বাংলাদেশে কোনো যোগ্য মানব-সন্তান নেই! উপজেলা পর্যায়ের সম্পাদক-সভাপতি হবার মতোদের টেনে হিঁচড়ে তুলে আনা হয়েছে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে। জাতীয় মানের সাংগঠনিক সম্পাদকদের কার্যকর কাজকর্ম দেখি না। ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জমানের নাম শোনা যায়। মাইনাসের জ্বীন ডেকে আনার অভিযোগে কোরবানি হলেন অনেক পরীক্ষিত নেতা। উপেক্ষা আর বাধ্যতামূলক পদচ্যুতির বাহারি নাম `উপদেষ্টামণ্ডলী`; আর তাতে ঠাঁই হলো সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক উত্তরাধিকারদের। রাজনৈতিক গর্দান হারালেন নিবেদিত আমু, পরীক্ষিত রাজ্জাক, বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণ হস্ত তোফায়েল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী, সাংগঠনিক দক্ষতায় অনন্য এককালের খ্যাতিমান ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না আর ছাত্রলীগের একমাত্র ডাকসু ভিপি সুলতান। পড়ে যেতে অল্পের জন্যে রেহাই মিললো বাগ্মী সুরঞ্জিতের। বাদবাকী নেতারা হয় আত্মীয়, নয় কদমবুচির।
টানা তিনবছর জাতি দেখলো আওয়ামী নেতৃত্ব নামধারী ‘সূর্যসন্তান’দের। তাদের গাঁটে কী পরিমাণ বিদ্যাবুদ্ধি আর যোগ্যতা আছে এরই মধ্যে জাতি তা বুঝে গিয়েছে। সকালের কথা উনাদের বিকেলে স্মরণে থাকে না। মাইন্ড ওপেন না থাকলেও আওয়ামী নেতৃত্বের ‘মাউথ’ কখনো বন্ধ হয় না। কখনো ‘মাউথগুলো’ ব্যস্ত থাকে চাটুকারিতায়। কখনো বিরোধী দলকে গালাগালিতে। আর লাগামহীন- অসমঞ্জস্ বাতচিত তো ওনাদের অলংকার! তিন বছরে আওয়ামী সভানেত্রীকে কোনো নেতা কোনো সুপরামর্শ দেয়াতো দূরের কথা, কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন কিনা জানি না। প্রধানমন্ত্রীর সব সিদ্ধান্তে ‘হুজুর হুজুর’ করার জন্যেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়কি?
যারা প্রশ্ন করতে পারেন ‘আশঙ্কা’ করা হয় তাদের ঝেটিয়ে দূরে বিদায় করা হয়েছে। হাতে আছে মাত্র দুটি ‘আওয়ামী বছর’। এতো অল্পদিনে নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ এককথায় অসম্ভব। দলীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয় প্রায় অসাধ্য এক আকাশকুসুম রূপকথা। পাবলিক কী চিজ এটা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। পরিকল্পিতভাবে পুরো দেশের জনগণকে দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে। তবু প্রতিকুলতার মাঝেও মাত্র পনেরো শতাংশের মতো নেতার গায়ে এখনো দলীয় তকমা লাগেনি, তারাই সব উল্টোপাল্টা করে দেবার জন্যে যথেষ্ট। ‘নারায়ণগঞ্জ শিক্ষার’ কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখি না।
বর্তমানের ইমম্যাচিউর নেতৃত্ব দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনাকারীদের প্রতি করুণা হয়। বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্বের কাছে মন্ত্রিত্বটাই যেন হয়ে উঠেছে মুখ্য। অথচ রাজনৈতিক সাফল্য মানে কিন্তু মন্ত্রিত্ব নয়। বাংলাদেশে মন্ত্রিত্ব হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের অস্কার। আইনের উর্ধ্বে থাকার আইনানুগ সনদ। কোটিপতি হবার ডিস্কভারি শাটল। একবার চড়ে বসলেই নিমিষেই ধনে জনে মহাকাশে উঠে যাওয়া যায়। মন্ত্রিত্বের বাইরেও রাজনৈতিক সম্মান থাকে এবং আছে। যারা আওয়ামী রাজনীতিতে নিবেদিত, স্বাধীনতার সপক্ষে সোচ্চার, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জ্বীবিত তারা কেবল রাজনৈতিক ধারবাহিকতায় সসম্মানে থাকতে ইচ্ছুক। আমু, তোফায়েল, মান্নাদের কাউকে বিনা মন্ত্রিত্বে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ দিলে হয়তো কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোল সম্ভব।
পত্রিকায় দেখলাম সুরঞ্জিত বাবুকে ডেকে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সংগে অতি অনুগত ওবায়দুল কাদেরকেও। তেল-পানির এই আহ্বান অদ্ভুত ঠেকেছে। সুরঞ্জিত বাবু যখন যা ভালো ভাবেন তাই নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন। ক্ষমতা পেলে কাদের সাহেবের এক ভাষা, ক্ষমতা হারালে তিনি বিপ্লবী!
বিরোধী বিএনপি এখন নতুন কৌশলে হরতালের বদলে লং মার্চে। ‘অতিমানব’ তারেককে বন্ধুবর শওকত মাহমুদ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় উপস্হাপন করছেন। উদ্যোগটি ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে ধারণা। বিপরীতে আওয়ামী লীগ বিব্রতকর ঘটনা-রটনার জন্মদাতা মন্ত্রী-সাংসদদের কর্মকান্ডে নিজেরাই অনেক ডিফেন্সিভ। হাইকোর্টের রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্হা বাতিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করা ছাড়া অন্য কোনো পথ আওয়ামী লীগের সামনে খোলা নেই। তারা যতোই জেদাজেদি করুক, নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে আওয়ামী লীগকে অহমিকা বাদ দিয়ে বাতিল তত্ত্বাবধায়কে ফিরিয়ে আনতে হবে। আওয়ামী লীগের ঘাড়ের কাছে বিএনপি’র ক্ষমতার নিঃশ্বাস। আর তাদের দু’জনার পেছনে ওয়ান ইলেভেনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ জনসমর্থিত আরেক প্রতীক্ষিত ’ঘাতক’।
ওপেন মাউথের অর্থহীন কথাবার্তায় কোনো কাজ হবে না। কাজ হবে মাইন্ড ওপেন করে আত্মসমালোচনা। কারণ হাতে সময় মাত্র সামান্য দু’বছর। এর মধ্যে ঘর গোছানোর পাশাপাশি ’সমস্যাগুলো’ পুরোপুরি ফিক্স না করতে পারলেও অন্ততঃ ’কার্পেটিং’ করতে হবে। সেইসংগে অর্জন করতে হবে জনগণের আস্হা। জনগণকে বোঝাতে হবে বিএনপি’র চেয়ে আগামী আওয়ামী সরকারই হওয়া উচিত কাঙ্ক্ষিত। কাজটা কিন্তু পেশাদার রাজনীতিকদের।
কিন্তু আওয়ামী লীগ কী ব্যক্তি অহমিকার উর্ধ্বে উঠে আবারো বুকে টেনে নেবেন `র্যাটস` (রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল, সুরঞ্জিত) আর মান্না-সুলতানদের? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে উনাদের ঠাঁই না-হলেও বিরোধী আওয়ামী লীগে উনারা নিশ্চিত থাকবেন সরব উপস্হিতিতে।
ইমেলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৮৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১১