১৯১২ সালের জুন মাসে তিনি ইংল্যান্ডের মিডল টেম্পল থেকে এল. এল. বি সম্পন্ন করেন। রেকর্ড সময় আড়াই বছরের মধ্যে তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
‘সন্দেহ নেই যে, আমার পসার এখন বেড়ে চলেছে। আমি পুরসভাতেও বড় কিছু করতে পারছি। কিন্তু আমার এই প্রসার কাল থাকতেও পারে, নাও পারে। আমার টাকা কাল শেষ হয়ে যাবে, আমার যারা উত্তরাধিকারী, তারাই এই টাকা উড়িয়ে দেবে। বরং তাদের জন্য টাকার চেয়ে আরও ভালো একটি উত্তরাধিকার আমি রেখে যেতে চাই। ’
প্যাটেল তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কথা পরবর্তীতে লিখেছেন, যে সময় তিনি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
গান্ধির সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্ত
১৯১৫ সালে হঠাৎ পাওয়া সুযোগে আহমেদাবাদের গুজরাট ক্লাবে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। মহাত্মা গান্ধির জীবন ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার একান্ত অনুসারীতে পরিণত হলেন প্যাটেল। গান্ধির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার যাত্রায় বেড়িয়ে পড়লেন। তিনি একটি সফল ‘কর দেবো না’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। যার পরিণতিতে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কৃষকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কৃষকদের সংগঠিত করায় প্যাটেলের বীরোচিত ভূমিকার কারণে তাকে সরদার খেতাব দেওয়া হয়। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় যার অর্থ নেতা। বঞ্চিত ও নিপীড়িত কৃষকদের অধিকার আদায়ে তিনি অহিংস প্রতিরোধের গান্ধিবাদি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধির সূচনা করা লবণ-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার দায়ে সরদার প্যাটেলকে কারাবন্দি করা হয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকা সত্বেও, মহাত্মা গান্ধির একনিষ্ঠ সমর্থক ও মিত্র থেকে যান প্যাটেল। ১৯৪২ সালে প্রভাবশালী নেতারা গান্ধির ভারত ছাড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অসহযোগ আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে স্বাধীনতা সংগ্রামের মতবিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। সরদার প্যাটেল বলিষ্ঠ কণ্ঠে গান্ধিকে সমর্থন জানিয়ে আসতে থাকেন এবং কার্যত বাধ্য হয়েই সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিকে ভারত ছাড় আন্দোলনে সমর্থন দিতে হয়।
ভারতকে ঐক্যবদ্ধকারী: লৌহ মানব
জাতি গঠনে দুর্দান্ত সাংগঠনিক যোগ্যতা ও অদম্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার কারণে সরদার প্যাটেল ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঐক্যবদ্ধকারী প্যাটেলকে যথার্থই স্মরণ করা হয় তার লৌহ কঠিন সংকল্প ও দৃঢ়তার জন্য। যার দ্বারা তিনি ৫০০-র বেশি দেশীয় রাজ্যকে সমন্বিত করে ফেডারেল ইন্ডিয়ার কাঠামো প্রস্তুত করেন। এই স্মরণীয় কীর্তির কারণেই তিনি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভূষিত হন, যার কারণে তাঁকে ভারতের লৌহ মানব বলা হয়ে থাকে।
সমাজ সংস্কারক প্যাটেল
রাষ্ট্রকে জাতীয় উন্নয়ন ও উত্থানের কারিগর হিসেবে দেখার ধারণাটি প্যাটেলের চিন্তারই বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি তার প্রচারিত রাজনৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কেবল একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্তম্ভই নয় বরং রাষ্ট্রকে একসঙ্গে টিকিয়ে রাখার জন্যও এই উপাদান দু’টি আবশ্যক। প্যাটেলের চিন্তায়, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হতে হবে রাষ্ট্রের সংবিধানের ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
বিশ্বায়নকারী হিসেবে প্যাটেল
সরদার প্যাটেল ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণকারী। যিনি প্রতীকী আদর্শবাদের পরিবর্তে একটি বাস্তবমুখী বৈদেশিক নীতির সুপারিশ করেন। তিনি উপর্যুপরি পরামর্শ দিয়ে গেছেন দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ যেন কিছুতেই নেওয়া না হয়।
প্যাটেলের ঐতিহ্য: জাতি গঠনকারী
সরদার প্যাটেল যদিও ভারতের স্বাধীনতার পর মাত্র আড়াই বছর বেঁচেছিলেন। এর মধ্যেই তিনি একটি আধুনিক, শক্তিশালী ও স্বনির্ভর ভারতের ধারণা তৈরি করে যান। ভারতের একক রাজ্যগুলোকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করার কৃতিত্বের জন্য প্রায়শ জার্মানির কিংবদন্তী নেতা অটো ভ্যান বিসমার্কের সঙ্গে তুলনীয় প্যাটেল জাতি গঠনে নানাভাবে ভূমিকা রাখেন। তিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নকারীদের সভায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ভিমরাও রামজি আম্বেদকরের নিয়োগে এবং সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক বলয় থেকে নেতাদের যুক্ত করতে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। খুব বেশি মানুষ জানেন না যে, সরদার প্যাটেল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ভারতের সিভিল সার্ভিসের স্বায়ত্ত্বশাসন ও নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে সংবিধানে অনুচ্ছেদ যুক্ত করে যান।
সরদার প্যাটেলের মৃত্যুর কয়েক দশক পরও ভারতের প্রতি তার নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের কথা ভারতের পুনরুত্থানে আত্মনিয়োগকারীদের উজ্জীবিত করে। তার জন্মদিনে কিংবদন্তিতুল্য এই মহান ব্যক্তির প্রতি আজও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে।
টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৪৭ সালের ২৭ জানুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয় সরদার প্যাটেলের ওপর। এর শিরোনাম দেয়া হয়- ‘দ্য বস’।
সরদার প্যাটেলকে ১৯৯১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
তার বাহ্যিক জীবনে এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিরলসভাবে তিনি নাগরিকদের সৎ ও আদর্শিক জীবন যাপন করার আহ্বান জানিয়ে এসেছেন। আর আবেদন রেখেছেন যেন তারা ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশ ও সমাজের স্বার্থকে সবসময় উপরে স্থান দেন। ১৯৪৮ সালে আলওয়ারের এক সভায় সরদার প্যাটেল যে ভাষণ দেন তা যেন এই জাতিকে স্বতস্ফূর্তভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, একজন মুক্ত নাগরিকের দায়িত্ব হলো সব নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং তার দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা। বন্দুকের জোরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য বিদেশী রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু দেশের ভেতরে, একজন স্বাধীন নাগরিকের নাগরিকদের সততা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি একাই পারে ষড়যন্ত্রী ও স্বার্থপর দল ও ব্যক্তিদের থেকে দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
এইচএডি/