ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কম্বল আর সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১
কম্বল আর সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ

অনেকদিন খালেদা জিয়া আর বিএনপির প্রশংসা করে লেখার সুযোগ পাই না। স্বাধীনতাবিরোধী আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে প্রকাশ্য মাখামাখি অথবা তাদের গার্জিয়ানশিপের কারণে তা সম্ভব হয় না।

আজ একসঙ্গে দুটি সুযোগ এসেছে। সোমবার রাতে ঢাকার কিছু এলাকার শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেছেন খালেদা জিয়া। অনেক বছর ধরেই শীতের রাতে শীতার্ত গরিব-দুঃস্থদের সহায়তার  প্রতীকী এ কাজটি তিনি করে আসছেন। এবারেও করেছেন বলে ধন্যবাদ।

দ্বিতীয় ধন্যবাদ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সংলাপে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে জাতীয় সংলাপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সোমবার রাতে চারদলীয় জোটের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গভবনের সূচি অনুসারে ১১ জানুয়ারি বিএনপির সঙ্গে এ সংলাপ হওয়ার কথা। এর আগে ৮ ও ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে দলটির রোড মার্চের কর্মসূচি আছে।

এরই মধ্যে এরশাদ ও মঞ্জুর জাপা-জেপি, জাসদ ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে আইন প্রণয়ণসহ ভালো কিছু প্রস্তাব এসেছে। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। মঞ্জু বলেছেন, চল্লিশ বছরে কোনো রাষ্ট্রপতি এই প্রথম এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিলেন। নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ক আইন প্রণয়ণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, চল্লিশ বছরে যা হয়নি, তা দেড় মাসে কী করে সম্ভব। রাষ্ট্রপতিও বলেছেন, আইন প্রণয়ণের প্রস্তাবটি ভালো। তবে তা এই স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব না। এরশাদ বলেছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঐকমত্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে আন্তরিক মনে হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে চারটি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এর সবক’টির নেতাদের কাছে কাদের নিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করা যায়, এ ব্যাপারে সম্ভাব্য নাম চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু কেউ নাম দেননি। পরে দেওয়ার কথা বলেছেন।
 
এখন বিএনপি কী তাদের পছন্দের নামের তালিকা সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে যাবে? এটা তাদের কৌশলগত ব্যাপার। তবে যেহেতু বিএনপির পরের দিনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ তাই নামের তালিকাটি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের চেনাজানা মুখস্ত রাজনৈতিক ধারাপাত তাই বলে। এখন এ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলের খেলা চলবে। প্রধান বিরোধীদল-সরকারি দল জানতে চাইবে পরষ্পরের মোটিভ। দাবার চাল চালাচালি আর কী! একজনের চাল দেখতে আরেকজন নিজের খেলার চাল চালতে চাইবে। এখন উভয় পক্ষ যাতে মনে রাখেন, দাবা একটা শান্তির খেলা।   কারণ এতে রাজা আছে রানী নেই। এখন দেশবাসীর আশা, দেশের রাজনৈতিক শান্তি বজায় রাখতে উভয় পক্ষ এ সংলাপকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন। আরেকটি সত্য যাতে মনে রাখা হয় তাহলো— এভাবে রাজনৈতিক সরকারের জমানায় কখনো সবার সঙ্গে আলোচনা করে কিন্তু নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হয়নি। এর আগে এরশাদ, খালেদা, হাসিনা কেউ তা করেননি। আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এর আগে যা হয়েছে, তা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ই হয়েছে। এবার আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আগাম একটি সংলাপের আয়োজন করেছে, বিএনপি সাড়া দিয়েছে সংলাপে। এ দুটি বিষয়ই দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক দিক।
 
এর আগের একটি লেখায় লিখেছিলাম, বিএনপি যাতে এই সংলাপকে প্রায়োরিটি হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে নেয়। এখনকার এক নম্বর প্রায়োরিটি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ অন্য বিষয়গুলো আসবে। এর সবকিছুই পরবর্তী নির্বাচনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এখন এমন আগে বিএনপি যেমন করেছে তেমনি আওয়ামী লীগও তা একা একা নতুন একটি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে ফেলতে পারত। শুভবুদ্ধির কারণে তারা সে গোয়ার্তুমি না করে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে হলেও একটি সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে। সংলাপে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বলা বিএনপির একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর সঙ্গে সকাল বেলায় ফজরের ওজুর সময় পানি দিলো না কেন, রাতের বেলা মিলনের সময় বাতি ছিলো না কেন জাতীয় সব দাবি মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না।
 
১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার সুযোগে দলের কোনো একটি পক্ষ অগণতান্ত্রিক একটা অশুভ খেলার চেষ্টা করেছিল তাতো সত্য।   যেমন— এর আগে পুলিশের সঙ্গে চোরাগুপ্তা হামলার যুদ্ধে জিতে যাওয়ার একটি অলীক স্বপ্ন দেখেছিল জামায়াত-শিবির। একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যেখানে গত প্রায় তিনযুগ ধরে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন সেখানে ভিন্ন চেষ্টা করলে যে ১/১১ আসে, ১/১১ যে কারো জন্যে আসে না। নিজেদের জন্য আসে, তখন উল্টো মেরুদণ্ডের ট্রিটমেন্টের জন্য আর রাজনীতি করবো না’ এমন দাসখত দিয়ে বিদেশ চলে যেতে হয়, এসব অভিজ্ঞতা কার না আছে! গত ১/১১ ওয়ালারা জামায়াতকে অনেক আদর করেছে। কিন্তু এখনকারওয়ালারা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মনিটর-সম্পন্নের জন্যে আলাদা সেল গঠন করেছে, এ খবর নিশ্চয় তাদের কাছেও আছে। অতএব বিএনপি বা তার শরীকদের কিছু পেতে চাইলে নির্বাচনের মাধ্যমেই পেতে হবে। সবশেষ ১৮ ডিসেম্বরের চোরাগোপ্তা স্টাইলে না। বিএনপি বা জামায়াত সে রকম কোনো গণমুখী বিপ্লবী দলও না। এসব দলের কুশীলব-ডোনাররা মূলত গুলশান-বনানী-বারিধারার বাসিন্দা। ওইগুলান ঢাকার বিপ্লবীদের পাড়া না।
 
এখন বিএনপি যে সংলাপে রাজি হয়েছে, এটি আওয়ামী লীগেরও একটি রাজনৈতিক সাফল্য। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হলো— রাষ্ট্রপতির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রধান বিরোধীদলের প্রথম দেখানো আনুগত্য। কারণ এর আগে দলটি সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ পর্যন্ত বর্জন করেছে। ইয়েস উদ্দিন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিদায় হওয়ার পর আর বঙ্গভবনেও যায়নি। এখন সংলাপকে সফল অর্থবহ করতে শাসকদল আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপির যুক্তিগ্রাহ্য প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে। তাদের প্রস্তাব একোমডেটিভভাবে নিয়ে যদি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যায়, তা সরকারসহ সকলের জন্য মঙ্গলের হবে। শান্তি পাবে দেশ। এখন বিএনপিসহ সবাইকে একোমডেট করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা গেলে, আগামী নির্বাচন সবাইকে নিয়ে করার পথেও তা হবে বড় একটি অগ্রিম অগ্রগতি। রাষ্ট্রপতি নামের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা-গ্রহণযোগ্যতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে যাওয়া চলবে না, দাওয়াত রক্ষা আর কবর জিয়ারতের রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে কিন্তু আগামী দু’বছর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাতে হবে।

জাতির সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি যদি কোনো অবহেলা-বড়ত্ব অথবা একগুঁয়েমির কারণে সরকারি দলের হাতে জবাই হয়, তাহলে আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। প্লিজ, সংবিধান সংশোধন নিয়ে এর আগে যে সংলাপ হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংলাপ যাতে সে রকম সাজানো, একতরফা না হয়। তখন সেখানে বাকবাকুম পায়রা সেজে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী হতে পেরেছেন। রাষ্ট্রপতির ওপরে আর কিছু নেই। আশা করি, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান জীবনের এই সময়ে এসে তেমন বাকবাকুম পায়রা হবেন না। বা তাকে এমন অপমানের বোঝা মাথায় তুলে দেবে না সরকারি দল।
 
লেখক সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক  

বাংলাদেশ সময়: ১২০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।