‘বাহাত্তর থেকে বিরানব্বুই। দু‘দশক।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের নিজস্ব রিপোর্ট বইটি পড়ছিলাম গভীর রাত ধরে। হঠাৎ যেন উপরিউক্ত কথাগুলোতে চোখ আটকে গেল। লাইনগুলো কয়েক বার পড়লাম। এই বাক্যগুলোর মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ করা আমার জ্ঞানরে-দীনতার কারণে কঠিন হয়ে পড়েছে।
মোনাজাতউদ্দিন গ্রামবাংলার চারণ সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে। ভূখানাঙ্গা, অভাবী-দরিদ্র, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের কল্যাণে। তিনি মাটি ও মানুষের সাংবাদিক। গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তিনি অবহেলিত গ্রামীণ সংবাদকে জাতীয় সংবাদে পরিণত করেছেন। খবরের পেছনের খবর খোঁজার সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর লেখনীশক্তির গুণে যোগ্য স্থানে কভার দিতেও কার্পণ্য করতেন না সেকালে নিউজরুমের সম্পাদকেরা।
কল্পনাপ্রসূত সংবাদ লেখার পক্ষে নন মোনাজাতউদ্দিন। তিনি কখনও কল্পনা বা শোনা কথায় সংবাদ লিখতেন না। সরেজমিন বা প্রত্যক্ষ করেই সংবাদ লিখতেন বলেই তাঁর সংবাদগুলো হয়ে উঠতো তথ্যবহুল-বাস্তবধর্মী। তাঁর সরেজমিন আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা টেলিফোন আর মোবাইলে বন্দী হয়ে সরেজমিন সংবাদ। সি-িকেটের কবলে পড়েছে সংবাদকর্মীরা। একই ধাঁচের সংবাদ, ছবি দেখা যায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ভিন্ন নামে, ভিন্ন চেহারায়। যেমন, মাঝে-মধ্যে টেলিভিশন নিউজে দেখা যায় লগো অন্য সংবাদমাধ্যমের। আর নিউজ দেখা যায় আরেক সংবাদমাধ্যমের।
মোনাজাতউদ্দিনের স্যুট ও সফর বিষয়ক লেখাটি ছিল একজন গ্রামীণ সংবাদকর্মীর জন্য আনন্দ-বেদনায় ভরা। তৎকালীন একজন গ্রামীণ সাংবাদিক রাষ্ট্রপতির সাথে বিদেশ সফরে যাবেন, তা কল্পনাও করা যায় না। একমাত্র মোনাজাতউদ্দিনের ভাগ্যেই জুটে ছিল সেই মাহেন্দ্র সুযোগটি। আজকাল বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সাথে সাংবাদিকদের বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাতে জুটে পত্রিকার স্টাফ রির্পোটার বা নিউজকক্ষের সাংবাদিকদের ভাগ্যে। মফস্বল বা গ্রামীণ সাংবাদিকদের ভাগ্যে তা কল্পনাতেও নেই। এছাড়াও কোনো সুযোগ-সুবিধার তো বালাই নেই-ই নেই। যেমন অভাগা যে দিকে যায় সাগরও শুকিয়ে যায়-এমন অবস্থা আজকের গ্রামবাংলার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে।
মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতার সেকাল বদলে গেছে। বদলে দিয়েছে প্রযুক্তি। গলাফাটা স্বরে টেলিফোন বা প্যাকেট পাঠানোর যুগ এখন আর নেই। নেই এনালগ ক্যামরায় ছবি তোলা, সেই ছবি নগর-শহরে গিয়ে প্রিন্ট করা, নিউজ লেখা-কতো ঝক্কিঝামেলা। এখন ডিজিটাল যুগ। ছবি ও নিউজ পত্রিকা অফিসে পাঠানো যায় কয়েক মিনিটে।
আমার কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রাম মহানগরীর সাথে লাগোয়া। অর্থাৎ কর্ণফুলী সেতু পার হলেই বোয়ালখালী। অথচ যোগ্য নেতৃত্বে অভাবে এখানে এখনো হয়নি কাক্সিক্ষত উন্নয়ন। কণফুলীর এপার থেকে যেন ডাক দিলেই ওপারে-শহরে শোনা যায়। অথচ ফোন করতে হয় আলাদা কোড ব্যবহার করে। টেলিফোনের অবস্থা যেন প্রাগৈতিহাসিকতার মতো। কয়েক বছর আগে এখানে ই-মেইল শব্দটি যেন স্বপ্নেও শোনেই জনগণ। ফ্যাক্সযন্ত্র নিয়ে ছিল না যন্ত্রণার শেষ। ফ্যাক্স করতে করতে চলে যেতে হতো পত্রিকা অফিসের কাছাকাছি-এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে সাংবাদিকতার এই ক্ষুদ্র জীবনে। আর আজকালের সাংবাদিকতা তো একেবারেই স্বপ্নর মতো। একটি সংবাদ একজনে লিখলে শুধু নাম বদল করেই চলে যাচ্ছে একাধিক পত্রিকায়। আর ঘটনার প্রত্যক্ষ বা সরেজমিনেও যেতে হয় না। মোবাইলে ফোনে তথ্য নেওয়া হয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেক। এই অমোঘ বাণীটি যেন আজকের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে (তবে সব ক্ষেত্রে নয়)। আজকের সাংবাদিকেরা বিজ্ঞানের কল্যাণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সামনে আরও অবারিত সুযোগের অপেক্ষা হাতছানি দেওয়ার অপেক্ষায়। সব কিন্তু নগর কেন্দ্রিক সাংবাদিকদের জন্য। মোনাজাতউদ্দিনের গ্রামীণ সাংবাদিকদের জন্য সেই সোনার ছেলে কবে জন্ম নেবে জানি না। জানি না গ্রামীণ সাংবাদিকতায় মোনাজাতউদ্দিনের মতো সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা কবে ফিরে আসবে।
আজকের গ্রাম্য সাংবাদিকতায় সৎ ও সততার কথা ভাবা যায় না। পত্রিকা থেকে সম্মানী ভাতার নামে দেওয়া হচ্ছে অসম্মানী ভাতা। নিজেদের লাজ-লজ্জার কারণে তা প্রকাশ করা যাবে না। এ জীবনে যেন সংসার ও পরিবারের অভিশাপ নিয়ে চলতে হয়। এভাবে তো আর দিন চলে না। দিন কাটবে না। সমাজ বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব সভ্যতা। গ্রামীণ সাংবাদিকরা কেন অভিসম্পাতরে জীবন নিয়ে বসে থাকবো। দিন দিন সৎ-সততা ও নীতি-আদর্শের কথা ভুলতে বসেছে গ্রামীণ সাংবাদিকেরা। তবে নানা হতাশার মাঝেও এখনো আশার বাণী দেখিয়ে চলেছেন অনেক সাংবাদিক। নানা দু:খবেদনার মধ্যে নীতিনৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতা করে চলেছেন।
নিজের মফস্বল সাংবাদিকতা জীবনে প্রভাবশালীদের পাহাড় কাটা, কর্ণফুলী নদী দখল, পুঁজিপতিদের শিল্প-কারখানা স্থাপনে নদী, খাল দখল-দূষণ, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের সংবাদ লিখতে কম্পিউটারের কীবোর্ডটি টিপতে মন চায় না। অন্যদের মতো প্রভাবশালীদের ডাকে মাথা নত করে দেখা করার অম্লান-মধুর স্বাদ জাগছে। প্রেসক্লাবের সকল সাংবাদিককে ম্যানেজ করতে হবে, না হয় সব পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হবে-সেই অমিত বাণী বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সংবাদ লিখলাম, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা-জরিমানা করলো। কালুরঘাট ও তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর টেন্ডারবাজির সংবাদে-টেন্ডার বাতিল হয়ে সরকারের রাজস্ব বাড়ল। আমার কী লাভ হল। সেই দিনের হিসেব-নিকেশে কষতে কষতে দিন কাটছে এখন।
সাংবাদিকতা জীবনের একটা পণ ছিল সৎ ও সততার সাথে জীবন কাটানো। তাই মোনাজাতউদ্দিনের লেখা বইগুলো পড়তাম বার বার। মনোযোগ দিয়ে। মনোজাতউদ্দিনকে দেখিনি। দেখার সুযোগ হয়নি। তবে তাঁর নীতি-আদর্শ থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি। তিনি আমাদের অগ্রপ্রতীক।
গত শুক্রবার রাতে টেলিফোনে এক সহকর্মী ফোনে একগাদা উপদেশ দিল। আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা উপদেশ। মেয়ের বয়স এখন আট মাস। সে বড় হচ্ছে...। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকেও একটি নিউজ না ছাপার অনুরোধের সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মেয়ের ভবিষ্যতের দোহাই দিয়েছিল তৎকালীন চিনি পাচারকারী সিন্ডিকেট। সেই তাগিদে মোনাজাউদ্দিনের উপরিউক্ত বাক্যগুলোর অবতারণা।
মোনাজাতউদ্দিন গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। কিন্তু আজকালের মফস্বল সাংবাদিকদের কজনই মোনাজাতউদ্দিনের জীবন ও কর্ম নিয়ে পড়েছি, জেনেছি, শিখেছি, শিখছি। তিনি কিভাবে সাংবাদিকতা করেছেন, পথ চলেছেন-তা তো আমাদের বোধগম্য নয়। তবে তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবসের স্মরণানুষ্ঠানে সবাই বলবেন, ‘মোনাজাতউদ্দিন...সাংবাদিক ছিলেন, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করার তাগিদ দেেবন। ’ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে করে এসব তাগিদ বেশি দেবেন। কিন্তু এ প্রজন্মের সাংবাদিক ক‘জন তাঁর নীতি-আদর্শ মেনে চলেন-জানি না।
আজকাল গ্রামীণ সাংবাদিকদের ‘গ্রাম্য’ বললে অনেকেই মনে হয় গালমন্দ করবেন। গ্রাম্য পরিচয় দিতে এখন আমাদের রুচিতে বাধে। কারণ সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের জাহির করতে আমাদের কোনো ত্রুটি নেই। তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় পেশাগত দক্ষতা, মান উন্নয়নের কথা বাদ দিলেও এখন সৌখিনতা এসেছে গ্রামীণ সাংবাদিকতায়। ঢুকে পড়ছে অপসাংবাদিকতাও। গুটিকয়েক অপসাংবাদিকরে কারণে বদনামের ভাগীদার হতে হচ্ছে সবাইকে।
মফস্বল সাংকাদিকতা এক মিনিটের নিশ্চয়তা নেই। তাই দাসত্ব মেনেই হয়তো চলতে হবে। কারণ এই বদনেশা যখন মাথায় চেপে বসেছে, শত কষ্টের মধ্যেও সেই ভূত মাথা থেকে আর নামছে না। অভিভাবকহীনভাবে চলছে মফস্বল সাংবাদিকতা। এদের পক্ষে কথা বলার নেই কেউ। রুটি-রুজির নিশ্চয়তা না থাকায় সৎ সাংবাদিকতার কথা ভুলে যাচ্ছে মফস্বল সাংবাদিকরা।
গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোনাজাতউদ্দিন ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর এ ধরণী ছেড়ে চলে যান পরপারে। তিনি আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা তাঁর নীতি-আদর্শ নিয়ে পথচলার স্বপ্ন দেখি। আজকের দিনে তাঁর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা।
মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, বোয়ালখালী প্রতিনিধি, দৈনিক পূর্বকোণ। চট্টগ্রাম।
e-mail : [email protected]