ক'দিন আগের কথা। দিল্লিতে তখন রাতের আঁধারে চলছে ভয়াবহ দাঙ্গা।
কে নিতে পারেন দাঙ্গা থামানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ?
দিল্লির মানবতাবাদী চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মীদের মনে এলো একটাই নাম- এস মুরলীধর। আইন পেশায় কাটানো ৩৬টি বছরে বিচারপতি এস মুরলীধর নীতির প্রশ্নে কোনোদিন আপস করেননি। তাই ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং নর্মদা বাঁধ তৈরির কারণে ঘরহারাদের জন্য লড়েছেন। মানুষকে কখনো ধর্ম বা রাজনৈতিক দল দিয়ে বিচার করেননি। সে কারণে শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য কংগ্রেসনেতা সজ্জন কুমারকে আইনের আওতায় আনতে পিছপা হননি।
দুর্যোগের রাতে এমন মানুষের ওপরই তো ভরসা রাখা যায়, রাখতে হয়! রাত গভীর হলেও তার বাড়িতেই ছুটে গেলেন সবাই। সেই রাতেই বসলো আদালত। দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ বর্মার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদনের শুনানি শুরু হলো সেই আদালতে।
বাকিটা ইতিহাস।
বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশেও যে রাজনীতি কত কদর্য রূপ নিয়েছে বিচারপতি মুরলীধর তা বিলক্ষণ জানতেন। তিনি জানতেন, দুদিন আগেও এই কপিল মিশ্র ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিতে। খুব ভালো করে নিশ্চয়ই এটাও জানতেন যে, দাঙ্গা থামানোর উদ্যোগে সাধারণ মানুষের উপকার হবে ঠিকই, কিন্তু 'ক্ষমতাবানরা' হবেন রুষ্ট।
হলোও তাই।
সেই রাতেই এলো বদলির আদেশ। বিশেষ আদালত বসানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এস মুরলীধর জেনে গেলেন দিল্লিতে তার ১৪ বছরের কর্মজীবন আপাতত শেষ।
মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে কোথায় পুরস্কৃত হবেন, হলেন বদলি!
অবশ্য তাতে কী এলো-গেল। তিয়েন আনমেন স্কয়ারে ট্যাংকের সামনে বাজারের ব্যাগ হাতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া মানুষটির মতো বিচারপতি এস মুরলীধরও নিশ্চয়ই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয়-বরণীয় থাকবেন।
দিল্লির মতো গত শুক্রবার গভীর রাতে কুড়িগ্রামেও বসেছিল আদালত। তার আগে হয়েছিল 'মাদক বিরোধী অভিযান'- এর নামে আতঙ্ক জাগানো এক অভিযান। জেলা প্রশাসনের একটি দল গভীর রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। পরিচয় জানতে চাইলে বলা হয়, "থানা থেকে এসেছি। " সঙ্গে সঙ্গেই থানার ওসিকে ফোন করেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি আরিফুল।
ওসি জানান, থানা থেকে কাউকে পাঠানো হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই দরজা খোলা হয়নি। জেলা প্রশাসনের দলটি তখন দুর্বৃত্তের মতো দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই পেটাতে শুরু করে আরিফুলকে। স্ত্রী আর দুই সন্তানের সামনে পেটাতে পেটাতেই বেঁধে তোলা হয় গাড়িতে। পরে বাড়িতে দেশি মদ এবং গাঁজা রাখার অভিযোগে সেই রাতেই আরিফুলকে কারাগারে পাঠায় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আরিফুল এবং তার পরিবারের দাবি, রাতে বাড়িতে 'দুর্বৃত্তের মতো' হামলা ও তারপরে দায়ের করা অভিযোগ এবং সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যত এক 'ক্যাঙ্গারু কোর্টের' দেওয়া কারাদণ্ডের আসল কারণ জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত রোষ। রোষের কারণ, সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক আরিফুলের লেখালেখি।
স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ এবং গণমাধ্যমের খুব প্রশংসনীয় উদ্যোগের ফলে একদিন পরই জামিনে মুক্ত হয়েছেন আরিফুল ইসলাম। জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে 'বিভাগীয় ব্যবস্থা' গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই 'বিভাগীয় ব্যবস্থা'র মানে কী? প্রত্যাহার করে নিলে কিংবা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি করলে 'অপরাধপ্রবণ' কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসে না। কুড়িগ্রামের আরডিসি নাজিম উদ্দীনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক আরিফুলকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারে থাকতেও সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় তিনি এমন আচরণ করেছেন। তার মতো মানুষের জন্য বদলি যে কোনো শাস্তিই নয়, আরিফুল ইসলামকে পিটিয়ে তিনি নিজেই তা প্রমাণ করেছেন।
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এবং নাজিম উদ্দিনসহ সাংবাদিক নির্যাতনে অংশ নেয়া প্রত্যেককে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, নইলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
আরও পড়ুন: ‘ভিউদস্যু’র কবলে রবীন্দ্রনাথ
লেখক: সাংবাদিক, ডয়েচে ভেলে, জার্মানি
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২০
এজে