দশ টাকার আলু বর্তমানে রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে ১৪-১৬ টাকায়। রাজধানীতে যে আলু ১৪ কিংবা ১৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা কৃষক থেকে ডিলাররা ক্রয় করছেন সাড়ে ৪ টাকায়।
সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশে বেড়েছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আকার আয়তন। আসছে আরও কয়েকটি। এসব মিডিয়া হাউসের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখন অনেকটা সিন্ডিকেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। নতুন-পুরানো যে কোনো হাউসে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের লোকজনই প্রাধান্য পাচ্ছে। সিন্ডিকেটের সাংবাদিক হলেই একজন আরেকজনকে কাছে টানছে। কিছুদিন আগে আমার এক সাবেক সহকর্মী নতুন একটি চ্যানেলে জয়েন করে আবার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর কারণ বর্তমানে মিডিয়া হাউসটির নেতৃত্বে যিনি আছেন তিনি তাকে ‘জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর’ বলাতে পারেননি। চ্যানেলটির নেতৃত্বে যিনি বা যারা আছেন তারা আমার সাবেক সহকর্মীকে বলেই দিয়েছেন অনুগত হয়ে না চললে অন্য জায়গা দেখ। একপর্যায়ে তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছেন। অথচ এ মাথামোটা ব্যক্তিটি/ব্যক্তিগুলো টেলিভিশনের টক-শোতে অনেক নীতিবাক্য ছাড়েন। মানবাধিকার, গণতন্ত্রের কথা বলেন। অথচ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের চর্চা হয় না তার হাউসেই।
মাস কয়েক আগে প্র্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই এক সাংবাদিক নেতার (যিনি সংবাদপত্রে গ্রাম্য পলিটিক্স করে চলেন) ডাক শুনে সালাম দিয়ে দাড়ালাম। কথা বলার একপর্যায়ে নিজ থেকে আমি সিন্ডিকেটের কথা উঠাতেই তিনি বললেন- ‘সিন্ডিকেট ছাড়া কিছু হইবো না। এগুলোর এন্ট্রিতে কিছু কইবা একদম হারাই যাইবা। ’ একটু খারাপ ভাষায় বললেন-‘সিন্ডিকেটে ঢুইকবা, ধান্ধাবাজি করবা, ভালো থাইকবা, চাকরিও যাইবো না, গেলেও আবার সিন্ডিকেটই তোমারে চাকরির ব্যবস্থা কইরা দিবো’। আমি কথার মোড় ঘুরিয়ে আমার সাবেক যে সহকর্মী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তার কথা তুললাম। বললাম তার চাকরি ফিরে পেতে কিছু করতে পারবেন কি-না আপনারা? পানের মুখ নাড়তে নাড়তে কিছুক্ষণ ভেবে বললেন-‘...যায়’। এ সাংবাদিক নেতা বললেন ঐ প্রতিষ্ঠানে যে সিন্ডিকেট আছে তাদের তোষামদি করে ঢুকতে। আর তা যদি না পারে তিনি আরেকটি জায়গায় তাকে চাকরি দিতে পারবেন জানালেন। তবে আমার সাবেক সহকর্মীকে যে প্রতিষ্ঠানে দেবে ঐ সিন্ডিকেটে থাকতে হবে। ঐ সিন্ডিকেটের কেউ সাংবাদিক ইউনিয়ন বা প্রেসক্লাবে নির্বাচনে দাঁড়ালে তার হয়ে নির্বাচন করতে হবে। এককথায় ‘মিডিয়া মুরুব্বি’দের পূজা করে চলতে হবে।
তরুণ সাংবাদিকদের সিন্ডিকেটে থাকা মানে ‘ইয়েস বস, ইয়েস বস’ করা। সিন্ডিকেটে থাকা মানেই সকল অন্যায় দেখেও মাথা নত করে থাকা। সাংবাদিকতায় সিন্ডিকেট মানেই মহান এ পেশার সঙ্গে প্রতারণা।
দেশে মিডিয়া হাউসের সংখ্যা বাড়ছে। সৃষ্টিশীল তরুণরা আগের চাইতে বেশি বেশি সাংবাদিকতায় আসতে চাচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অযোগ্য আর মেধাহীনে ভরে উঠছে গণমাধ্যম। সাংবাদিকতা পেশাও হয়ে পড়েছে এখন লবিং-নির্ভর। লবিংয়ের জোর যার যত বেশি তার আসন তত পাকাপোক্ত। যোগ্যতা অনেকটাই গৌণ হয়ে আসছে ক্রমাগত। অনেক অযোগ্যই গণমাধ্যমে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। ভাষাগত দক্ষতা, সংবাদ নির্মাণসহ অনেক দক্ষতা থাকার পরও গণমাধ্যমে অনেক তরুণের মূল্যায়ন হচ্ছে না কিছু মিডিয়া-মুরুব্বির কারণে। সাংবাদিকতা পেশাকে এসব মুরুব্বিই ভিলেজ পলিটিক্সে পরিণত করেছেন। অনেক মিডিয়া হাউসে এখন কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নেই তথাকথিত মুরুব্বিদের কারণে।
২০০৮ সালে শুরুর দিকের ঘটনা। আমার এক রিপোর্টার বন্ধু (সঙ্গত কারণে নাম বলছি না) একটি দৈনিকে সবে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। অদ্ভুত কারণে তাকে ঐ পত্রিকার বার্তাপ্রধান কেনো জানি পছন্দ করে না। এর কারণ আমার সাংবাদিক বন্ধুটিও আবিষ্কার করতে পারলো না। জয়েন করার পর থেকেই বার্তাপ্রধান কারণে-অকারণে তার ভুল খোঁজেন। একদিন তাকে রুমে ডেকে একটি বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে অ্যাসাইনম্যান্ট দিয়েছেন (যদিও যে বিষয়টি দিয়েছেন তা তার বিট নয়) পরের দিন রিপোর্ট করে বার্তাপ্রধানকে দেখালেন। বার্তাপ্রধান রিপোর্টটির উপরের দিকে আর নিচের দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন, ‘কিছুই হয়নি, এসব বস্তা পচা কী লিখো মিয়া?’। খুব কষ্ট পেয়ে ঐ রিপোর্টার অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সংশ্লিষ্ট সাপ্লিমেন্ট পাতার সাব এডিটরকে দিয়েছেন। দৈনিকটির মূল পাতায় নিউজটির স্থান না হলেও সাপ্লিমেন্ট পাতায় ছাপা হয়। বার্তাপ্রধানের বলা সেই বস্তা পচা রিপোর্টটিই কয়েকমাস পর আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড এনে দেয় এ সাংবাদিককে।
বর্তমান প্রজন্মের যোগ্য সাংবাদিকরা তাদের কাজেই প্রমাণ দিচ্ছেন তারা ভালো করছেন। তাদের সৃষ্টি, সংবাদ নির্মাণই কথা বলে তারা কতটা যোগ্যতা রাখেন। তবুও বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে চলেছেন কিছু মাথামোটা মুরব্বি সাংবাদিক। যারা সাংবাদিকতা পেশাকে এগিয়ে নিতে কোনো ভুমিকাতো রাখেনইনি; উল্টো গণমাধ্যমকে অযোগ্য লোক দিয়ে আগাছার দঙ্গল বানিয়ে রেখেছেন। কাঁচাবাজারের মতো সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
গণমাধ্যমের মতো পবিত্র এই সেক্টরকে যারা সিন্ডিকেটের লোকজন দিয়ে ভরে তুলেছে। একদিন এসব সিন্ডিকেট ভাঙবে কিছু সৃষ্টিশীল তরুণ। ইনসেটে পড়ে থাকা কিছু তরুণের মেধাকে যেসব মিডিয়া মাস্তান চেপে রেখেছে একদিন মিডিয়া মোগলদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এ প্রজন্মের মেধাবী তরুণ সাংবাদিকরা।
তারপরও এসব ‘স্বাভাবকিতার’ মধ্যে আমরা যারা ভালো রিপোর্ট করতে চেষ্টা করি, সম্পাদনা করি, ভাইটাল ডেজ ইভেন্ট কাভার করতে চাই, আমরা আশাবাদী। যদিও মিডিয়া হাউসের সিন্ডিকেটের সিলিংয়ে আটকা পড়ে আছে আমাদের আশাবাদ।
প্রফেশনালিজমের নামে নন-প্রফশেনাল ‘বাবু এবং তার তোষামোদ চক্র’ ক্রমেই নিউজ রুমের পরিবেশকে ভিলেজ পলিটিক্সে নিয়ে যাচ্ছে। তবু নিশ্চিত জানি এই সিলিং ফ্যান ভাঙবে একদিন। যোগ্যতার জয় হবে একদিন। জয় হবে সৎ সাংবাদিকতার!
লেখক-সাংবাদিক
ই মেইল[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১১