চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ হয়েও হংকং, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া করোনা মোকাবেলায় বিশেষ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। তবে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে তুলনামূলকভাবে জার্মানকে সফল বলা যায়।
১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে। ১ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন দেশ রয়েছে পাঁচটি। এগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার।
অন্যদিকে মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে এমন দেশ ১০টি আর পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে এমন দেশ ছয়টি (সূত্র: ওয়ার্ল্ডওমিটার)। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত জার্মানিতে শনাক্ত হয়েছে এক লাখ সাতাশ হাজার আটশ চুয়ান্ন জন। এর বিপরীতে মৃত্যুবরণ করেছে তিন হাজার বাইশ জন। অর্থাৎ মৃত্যু হার ২.৩৬ শতাংশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্যে মৃত্যু হার যথাক্রমে ৩.২০, ৯.৮৯, ৯.৪৭, ১২.৬৩ ও ১১.১৪ শতাংশ।
করোনা মহামারি শুরুর দিকে খারাপ অবস্থা হওয়া চীন ও ইরানে মৃত্যুহার যথাক্রমে ৪ ও ৬.১৮ শতাংশ।
অন্যদিকে ‘ক্লোজড কেসে’র ক্ষেত্রে মৃত্যুহার যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭, স্পেনে ২৪.৫৩, ইতালিতে ৪১, ফ্রান্সে ৩৫ শতাংশ। তবে ভয়ানক অবস্থা যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে। সেখানে ‘ক্লোজড কেসে’র ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৯৭.৮৫ শতাংশ। এগুলোর সম্পূর্ণ বিপরতী চিত্র লক্ষ্য করা গেছে জার্মানিতে। সেখানে ‘ক্লোজড কেসে’র ক্ষেত্রে মৃত্যুহার মাত্র ৫.২৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাচ্ছে জার্মান অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পর সম্ভবত জার্মানিই করোনায় মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পেরেছে। ইপিডিমিওলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো- দ্রুত ও বিস্তৃত পর্যায়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা, প্রচুর পরিমাণে ভেন্টিলেটরসহ নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্র (আইসিইউ), সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কিত নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা।
জার্মানির সফলতার পিছনে মূলত কাজ করেছে অধিক পরিমাণে পরীক্ষা। ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে জানুয়ারির মাঝামাঝিতেই জার্মান কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে, জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত চ্যারিটি হাসপাতাল পরীক্ষা জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং পরীক্ষার ফর্মুলা অনলাইনে প্রকাশ করে। ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশব্যাপী যথেস্ট পরিমাণে পরীক্ষার কিটসহ পরীক্ষাগার প্রস্তুত করা হয়। জার্মান বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার টেস্ট করছে যা ইউরোপের অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি। দ্রুত ও বিস্তৃত পরীক্ষার মাধ্যমে সরকার আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহজে ‘আইসোলেট’ করতে পারছে। তাছাড়া বেশি পরীক্ষার কারণে করোনার লক্ষণ নেই কিন্তু আক্রান্ত এমন ব্যক্তিকেও শনাক্ত করে আইসোলেট করা যাচ্ছে। এ কারণে জার্মানিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও এটি সংক্রমণ কমাতে সহায়তা করছে। পাশাপাশি সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা কমাতেও সহায়তা করছে।
এ প্রসঙ্গে জার্মানির হাইডেলবার্গের ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান জর্জ ক্রসলিস বলেন, যখন আমি একজন রোগীর দ্রুত পরীক্ষা করতে পারবো তখন তার দ্রুত চিকিৎসাও দিতে পারবো এবং তার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে যদি তাকে ভেন্টিটেলর দেওয়া যায়, তাহলে তার বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এছাড়া মেডিক্যাল স্টাফরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ও ছড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে। এটাকে বিবেচনা করে জার্মানির কিছু হাসপাতাল তাদের কর্মকতর্মাদের ‘ব্লক টেস্ট’ করছে। প্রতি ১০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে টেস্ট করা হয়। এতে যদি পজিটিভ আসে তাহলে ১০ জনের প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদা টেস্ট করা হয়। এর বাইরে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু তৈরি হয়েছে তা বোঝার জন্য এপ্রিলের শেষের দিক থেকে প্রতি সপ্তাহে ১ লাখ লোকের এন্টিবডি পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করছে।
জার্মানির করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিনা মূল্যে পরীক্ষা করা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য অনেক দেশই প্রথম দিকে বিনামূল্যে পরীক্ষা করেনি। তবে অতিসম্প্রতি (গত মাসের শেষের দিকে) করোনা ভাইরাস রিলিফ বিল পাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বিনামূল্যে পরীক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিনামূল্যে পরীক্ষা না থাকার কারণে অনেকেই হয়তো পরীক্ষার জন্য আগ্রহী হোন না। তাই বিনামূল্যে পরীক্ষাটা খুব জরুরি।
জার্মানিতে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে দ্বিতীয় যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো সন্দেহভাজন করোনা রোগী বের করে পরীক্ষা করা। জার্মানিতে সম্ভাব্য প্রায় সবাইকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে যাদের শরীরে লক্ষণ ছিল না এমন লোকও পরীক্ষার আওতায় আসছে। বিশেষ করে কেউ যদি কোনো অনুষ্ঠানে বা কোনো জন-সমাগমে অংশগ্রহণ করে সেখানে যদি কোনো পজিটিভ রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে সেখানে অংশগ্রহণকারী সবাইকেই পরীক্ষা করা হচ্ছে। লক্ষণ থাকুক বা না থাকুক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বনের ইউনিভার্সিটি হসপিটালে প্রথম যে রোগী শনাক্ত হয়, তার কোনো লক্ষণ ছিলো না। লোকটি একটি স্কুলে চাকরি করতেন। তিনি একটি কার্নিভালে অংশ নেন যেখানে করোনা পজিটিভ রোগী ছিল। তার স্কুল যখন বিষয়টি জানতে পারে তখন তাকে পরীক্ষার জন্য বলে। যখন ওই ব্যক্তির পজিটিভ রেজাল্ট আসে সঙ্গে সঙ্গে ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ করে দেয়। ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের দুই সপ্তাহ বাসায় থাকতে বলে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ২৩৫ জনের মত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা হয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গে জার্মানির এখানেই পার্থক্য।
যুক্তরাষ্টসহ অনেক দেশই কেবলমাত্র অসুস্থ লোককেই পরীক্ষা করছে। কিন্তু জার্মান যদি শুধু লক্ষণ দেখে পরীক্ষা করতো, তাহলে ওই স্কুলের কর্মকর্তার মতো অনেকেই পরীক্ষার বাইরে থেকে যেতো এবং অন্যদের সংক্রমিত করতো। জার্মান কর্তৃপক্ষ সেই সুযোগ দিচ্ছে না। সম্ভাব্য রোগী ট্র্যাকিং ও ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা আওতায় নিয়ে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষা ও ট্র্যাকিং দক্ষিণ কোরিয়ায় ভালো ফল দিয়েছে। জার্মানি কর্তৃপক্ষ কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংকে আরও গুরুত্বসহকারে ব্যবহার করেছে। বাইরে থেকে যারা জার্মানিতে এসেছে তাদের প্রায় সবাইকে ট্র্যাকিং করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
জার্মানির আরেকটি ভালো দিক হলো সেখানকার শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চীনে করোনা প্রদুর্ভাবের পর জানুয়ারি থেকেই জার্মানিব্যাপী হাসপাতালগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে জানুয়ারিতে জার্মানের হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরীক্ষা কিটসহ চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে উপযোগী করা হয়েছে। জানুয়ারিতেই জার্মানিতে ২৮ হাজার ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেড ছিলো। অর্থাৎ প্রতি এক লাখ লোকের জন্য ৩৪টি আইসিইউ। যেখানে ইতালিতে সমপরিমাণ লোকের জন্য ১২টি এবং নেদারল্যান্ডে ৭টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তবে বর্তমানে জার্মানিতে মোট ৪০ হাজার আইসিইউ বেড রয়েছে। জার্মানি এখন স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্সের রোগীদেরও সেবা দিচ্ছে। এর মাধ্যমেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জার্মানির সক্ষমতা বোঝা যায়। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জার্মানিতে ভেন্টিলেটরের মতো জীবনরক্ষাকারী উপকরণগুলো সংকট তৈরি না হওয়ার পিছনে কাজ করেছে সঠিক ও কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখর কৌশল বাস্তবায়ন হওয়া।
ব্যাপক পরীক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তুতির পাশাপাশি জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেলের সময়োচিত সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একজন প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি এই সংকটের শুরু থেকেই নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখার পদক্ষেপটা খুবই কঠোরভাবে আরোপ করেছিলেন। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের ওপর জোর দিয়েছেন। তার সময়োচিত পদক্ষেপ প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসা পেয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
(বি.দ্র. লেখাটি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘A German Exception? Why the Country’s Coronavirus Death Rate Is Low?’ অবলম্বনে লেখা। )
লেখক: গবেষক ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (গবেষণা ও পলিসি), টিআইবি