বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কৃষিনির্ভর হাওর এলাকায়ও এর প্রভাব পড়বে নিশ্চিতভাবেই। তবে যেহেতু ইতোমধ্যেই হাওরে ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে, তাই ওই এলাকায় এর প্রভাব আগেভাগেই দৃশ্যমান হয়ে গেছে।
দেশের বোরো মওসুমের মোট ধানের উৎপাদনের প্রায় ২০ ভাগ আসে হাওর এলাকা থেকে। তাই হাওরের ফসল সঠিকভাবে ঘরে তুলতে না পারলে তা সারাদেশের খাদ্যের মজুদে একটি বড় ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই কৃষি পণ্য দ্রব্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে হাওরের বোরো ফসল সঠিকভাবে উত্তোলন জরুরি। ইতিমধ্যেই হাওরের কৃষকের মনে দুটি শংকা কাজ করছে। প্রথমত, ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক নেই। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যেই পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে এ মাসের শেষার্ধে ভারতের আসাম, মেঘালয় এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতে পারে। অতীতে দেখা গেছে আসাম ও মেঘালয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বা উপচে হাওরে পানি ঢুকে যায়। তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নের সোনার ফসল।
এই অকাল বন্যার কারণে হাওরবাসী সব বছর বোরো ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। এই শতকে গত ২০ বছরে তাদেরকে আটবার ফসলহানির মুখোমুখি হতে হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় শত ভাগ ফসলহানি হয়। ফসল গেছে হাওরের অন্যান্য জেলারও।
হাওরে এমনিতেই ধান কাটার শ্রমিক সংকট থাকে। এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে শ্রমিক সংকট আরও প্রকট হতে পারে। ধান কাটার জন্য পাবনা, টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক শ্রমিক হাওরে আসেন। কিন্তু এবছর করোনা ভাইরাসের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় এবং সুনামগঞ্জ জেলা লকডাউন ঘোষণা করায় এসব শ্রমিকরা আসতে পারবেন না। আসাটা সমীচীনও নয়। বাইরে থেকে শ্রমিক না এলেও জেলার অভ্যন্তরে এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বা উপজেলার অভ্যন্তরে শ্রমিকের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ধান কাটতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর এই বিলম্বের কারণে অকাল বন্যার মুখে পড়তে পারে হাওরের ফসল।
অন্যদিকে বাইরে থেকে শ্রমিক আসার ফলে যদি ধান কাটার শ্রমিকদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তা মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। অতীতে কলেরা বা গুটি বসন্তের কারণে অনেক এলাকায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। করোনার কারণে জমিতেই পড়ে থাকতে পারে ধান। এতে দেশে মোট খাদ্যের উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
যেসব শ্রমিকরা এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় চলাচল করবেন তাদের শরীরে যেন করোনার কোন উপসর্গ না থাকে সেটি নিশ্চিত করেই তাদেরকে আনতে হবে। এর পাশাপাশি যখন শ্রমিকরা হাওরে ধান কাটবেন তখন যেন তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধান কাটেন সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ধান কাটা, ধান মাড়াই এবং ধান শুকানো এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক দূরত্ব আমরা যদি বজায় না রাখতে পারি তাহলে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর একটি আশঙ্কা থেকে যায়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। একই সাথে সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করেন এবং তারা যেন নিরাপদ দূরত্বে থেকে চলাচল করেন সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। দূর থেকে যেসব ধান কাটার শ্রমিকরা আসেন তারা রাতে ২০/৩০ জন করে একেকটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন। এতে তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব। তাই তারা যাতে রাতে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাতে পারেন সে দিকটি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকার ইতিমধ্যেই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত যেন কার্যকর হয় অর্থাৎ স্কুল কলেজ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যেন ধানকাটা শ্রমিকদের তাদের প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থা করে দেন সে বিষয়টি মনিটরিং করা জরুরি। অনেক জায়গায় হাওর থেকে নিকটবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব অনেক বেশি। সেসব জায়গায় সরকার অস্থায়ীভাবে ঘর নির্মাণ করেও শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারে।
ধান কাটার সময় কোনো শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে যেন সাথে সাথে চিকিৎসা পান বা তার করোনার কোন উপসর্গ আছে কিনা সেটি নিশ্চিত করার জন্য হাওরে থাকতে হবে ভ্রাম্যমান মেডিকেল টিম। এসব মেডিকেল টিম তৎপর থাকলে বা সম্ভাব্য কোনো রোগী থাকলে তাকে টেস্ট করানোর জন্য পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠালে প্রাদুর্ভাব থেকে হয়তোবা শ্রমিকরা রক্ষা পেতে পারেন। একই সাথে ঐসব মেডিকেল টিমের পরামর্শে কোনো শ্রমিককে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনে রাখা যেতে পারে । শ্রমিকদের করোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখার আরেকটি উপায় হল স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলা। মেডিকেল টিম এ ব্যাপারেও শ্রমিকদের সতর্ক করতে পারে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে মাস্ক, সাবান, গামছাসহ অন্যান্য উপকরণাদি সরকার বিনা মূল্যে বিতরণ করতে পারে।
শ্রমিকরা যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন এইজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য হাওরে হাওরে মাইকিং করা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রচারণা চালাতে হবে রেডিও-টিভি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
হাওরের জমিগুলো সাধারণত নিচু এলাকার হওয়ায় মাটি নরম থাকে তাই সব জমিতে ধান কাটার মেশিন বা রিপার ব্যবহার করা যায় না। যেসব জায়গায় মেশিন ব্যবহার করা সম্ভব সেসব জায়গায় যেন সরকার অধিক হারে মেশিন ব্যবহার করার সুযোগ দেন। মেশিন ব্যবহার করতে হবে ধান মাড়াই এবং শুকানোর কাজেও। তাই ঐ এলাকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা কৃষি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মেশিনগুলো সচল রাখার পাশাপাশি অন্যান্য এলাকা থেকে কিছু মেশিন এনে ধান দ্রুত ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ সম্পন্ন করা দরকার। একই সাথে দরিদ্র কৃষকরা যেন স্বল্প খরচে এসব মেশিন ব্যবহার করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। এইসব মেশিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধনী কৃষকদের দাপটে গরীব কৃষক যাতে বঞ্চিত না হন সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে এবার হাওরের ৭ জেলা সুনামগঞ্জ , সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওরেই হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এবার হাওর অঞ্চলে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। আর এ বছর সারাদেশে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ ভাগ জোগান দেয় হাওর অঞ্চলের বোরো ধান। সরকার ইতিমধ্যেই ধান চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ও দাম ঘোষণা করেছে।
খাদ্যমন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বোরো মওসুমে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিন টন আতপ ও সেদ্ধ চাল এবং ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম কিনবে সরকার। ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা কেজি দরে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ২৬ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। চলতি মাসের ২৬ এপ্রিল থেকে ধান ও ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হবে এবং সংগ্রহ শেষ হবে ৩১ আগস্ট। এছাড়া ২৮ টাকা কেজি দরে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৫ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম কেনা হবে। যদিও ২০১৯ সনে সরকার বোরো মওসুমে ৪ লাখ টন ধান ও ১৪ লাখ টন চাল সংগ্রহ করেছিল।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই ধান-চাল সংগ্রহের পুরো প্রক্রিয়ায় সাধারণ কৃষকদের চেয়ে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই বেশি লাভবান হয়। এইসব মধ্যস্বত্বভোগীদের হটিয়ে কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হবে। সরকারিভাবে ধানের চেয়ে চালই বেশি কেনা হয়। চাল দিয়ে থাকে চালকল মালিকরা। আর ধান দিয়ে থাকে কৃষক। তাই চালের পরিবর্তে অধিকহারে ধান ক্রয় করলে সরাসরি কৃষক লাভ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এজন্য ধান ক্রয়ের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। সরকারিভাবে ক্রয় কৃত ধান চালের পরিমাণ আরও বাড়লে তা বাজারকে আরো অধিক হারে প্রভাবিত করতে পারে। এর পাশাপাশি এই সংকটকালীন সময়ে দেশে খাদ্যের উল্লেখযোগ্য মজুদ নিশ্চিত করা যাবে। যা এই দুর্যোগকালীন সময়ে খুবই প্রয়োজন। সরকার ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখা যাবে না। ঘরে তুলতে হবে সকল ফসল। কিন্তু শুধু সরকারের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমাদের সকলকে ঘরে বসে থাকলে চলবে না।
হাওরে ধান কাটার সময়টা এমনিতেই থাকে উৎসবমুখর। স্কুলের ছাত্র, শিক্ষকসহ আবালবৃদ্ধবনিতা এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হন। বাদ যান না নারীরাও। তারা ধান কাটতে না গেলেও ধান শুকানো এমনকি মাড়াইয়ের কাজেও সহযোগিতা করে থাকেন। এবছর যেহেতু সংকট আরো গভীর, তাই সবাইকেই এই ধান কাটার প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়ে যেতে হবে। এবার কিন্তু হাওর এলাকার অন্যান্য শ্রমিক যারা শহরে কাজ করতেন তারাও হাওর এলাকাতেই অবস্থান করছেন। তাই তাদেরকেও ফসল তোলার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন হাওরের ধান কাটা হবে অন্যদিকে তাদের ও বেকারত্ব ঘুচবে। করোনার ব্যাপারে সর্তকতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদি ব্যাপারে পাড়া-মহল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক দলগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। ধান কাটায় সবাই কে উৎসাহিত করতে সরকারি সহযোগিতার ক্ষেত্রে এদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
সরকারিভাবে ইতিমধ্যেই দ্রুত হাওরের ফসল কাটার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। সকল বালুমহালে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। কৃষিপণ্য ও যন্ত্রপাতির দোকান খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মেডিকেল টিম করা হয়েছে। যারা ধান কাটবে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে দ্রুত ধান কেটে ফেলার নির্দেশনা। তবে হাওরবাসীকে মনে রাখতে হবে, এই কাজ সরকারের একার নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
দুই বছর আগের হাওরের ফসলহানির দগদগে স্মৃতি এখনো কৃষকের মনে। এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা আর হতে চান না। তাই দ্রুত হাওরের ধান কেটে গোলায় তোলা বা সরকারি গুদামে বিক্রি করার প্রচেষ্টায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা এবং সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ সকল শঙ্কাকে উড়িয়ে হাওরে শান্তি নিশ্চিত করবে এমন প্রত্যাশা সকলের।
মনে রাখতে হবে, হাওরের ফসল উত্তোলন কৃষকের শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সারাদেশের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই হাওর বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে হাওরের ফসল সুষ্ঠুভাবে উত্তোলন করা হোক। বিষয়টি যেন স্পটলাইট থেকে দূরে সরে না যায়।
লেখক: সভাপতি, পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা