ধানের শীষের একজন প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই কী বিষয়, নির্বাচন নিয়ে সিরিয়াস নন কেন? ধানের শীষ পেয়েছেন, মাঠে নামেন ঠিক মতো। উত্তরে তিনি বললেন, ‘ভাই, এই ধানের শীষ পেতেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
আমি যে দলটির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সে দলেরও কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন। তারা তাদের ইউনিয়নে একেবারে নৌকা বা ধানের শীষের প্রার্থীর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের প্রচণ্ড ক্ষোভ। পুরো নির্বাচনের সময়টাতে আমি ছিলাম। ক্ষোভের বিষয় কিন্তু রাজনীতি নয়, কিংবা প্রার্থীরা প্রচারণায় যাচ্ছেন না, অথবা জনগণের কাছে যাচ্ছেন না, এগুলো নয়। অধিকাংশেরই ক্ষোভ ছিল ভাই প্রার্থী ‘খরচ’ করে না। এসব নিয়ে সব দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের একই অভিযোগ। আবার এমনও দেখা গেছে, কেন্দ্র থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে এসেছে, কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য বা দলের নেতাদের খুশি করতে পারেন নাই, তাদের বিরুদ্ধে দলের বিভিন্ন নেতার অনুসারীরাই অপপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এগুলো আলোচনা করলাম এই কারণে যে, এই করোনা দুর্যোগের সময় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল, টিসিবির কম মূল্যের তেল আত্মসাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার ঝড় চলছে। পাঠক মনে করতে পারেন, আমি ওই সকল চোরদের পক্ষে কথা বলতে চাই! আসলে বিষয়টি তেমন নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিরা কেন চোর হবেন? তাদের চোর হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? এগুলো একটু ভেবে দেখা দরকার।
একসময় দেখা যেত, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের সম্পদ শেষ করে রাজনীতি করেছেন। আর এখন তার বিপরীত চরিত্র প্রকাশ পায়। বড় কোনো দলের ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতা হতে পারলেই কেল্লা ফতে। ভাগ্য খুলে গেল তার। গত ত্রিশ দশকের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে এমনও দেখা যাবে, বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা হয়েও দুই বছরে নতুন মডেলের গাড়ি কিনেছেন। আবার যুব সংগঠনের পদ কিনতে দলের শীর্ষ নেতাকে ২৫/৩০ লাখ টাকার গাড়িও উপহার দিয়েছেন। এমন ঘটনা কারো অজানা নয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের রং বদলাতেও খুব বেশি সময় লাগে না।
স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগ সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। যারা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছেন ও গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারা এসব অভিযোগের সঙ্গে সব সময়ই পরিচিত। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরকে গ্রামের মানুষ ভয়ে সমীহ করলেও খুব বেশি সম্মান করেন বলে মনে হয় না। তবে এই মানুষগুলোই বার বার নির্বাচিত হয়। কারণ জনগণেরও মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। জনগণ মনেই করে, এদেরই নির্বাচিত করতে হবে, না হলে কাজ হবে না।
৮০ দশকের শেষভাগে এক স্থানীয় নির্বাচনে একজন সুশিক্ষিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নেমেছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে জনগণের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি সবাই বলেছে, প্রার্থী হিসাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী। কেউ তার বিরোধিতা করেননি। নির্বাচনে প্রায় চূড়ান্ত সময়ে একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সবাই বলছে, ভাই প্রার্থী ভালো-সৎ-যোগ্য। কিন্তু একে দিয়ে কাজ হবে না। এত ভালো মানুষ দিয়ে কাজ হয় না। নির্বাচনেও তাই প্রমাণিত হলো। বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন আমাদের সৎ-যোগ্য-ভালো প্রার্থী। এমনকি তার বাড়ির কেন্দ্রেও তিনি বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। এই হচ্ছে আমাদের সামাজিক ব্যাধি।
১৯৯৬ সালে একটি বড় দলের সংসদ সদস্য প্রার্থীদের মনোনয়ন বোর্ডে পরীক্ষার কিছু বিষয় জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সব প্রার্থীর কাছে দলের মনোনয়ন বোর্ডের একটি কমন প্রশ্ন ছিল। তাহলো, নির্বাচনী ব্যয় ঠিক মতো করতে পারবেন তো? সর্বোচ্চ কত করতে পারবেন?
আমরা প্রায় সকলেই জানি সারা জীবন দলের জন্য কাজ করা নেতা-কর্মীরা ছিটকে পড়ে যান মনোনয়ন বোর্ডে। সেখানে স্থান দখল করে নেন কালো টাকার মালিক আর ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন তার সবচাইতে বড় উদাহরন নয় কী? একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী কি সেই আসনটি নিয়ে নিলো না? কেন? এই প্রশ্নের কি কোনো উত্তর আমাদের জানা আছে? সরকারি দলে কি কোনো যোগ্য-ত্যাগী নেতা ছিলেন না?
এই প্রশ্নগুলোর সমাধান না হলে আর কোনো প্রশ্নেরই সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না। মনোনয়ন দেবেন কালো টাকার মালিক আর দুর্নীতিবাজদের, আবার আশা করবেন সততার। এই দুটি কি এক সঙ্গে হয়, নাকি হতে পারে? একজন রাজনৈতিক কর্মী তৃণমূল থেকে উঠে আসতে আসতে জীবনের পড়ন্ত বেলায় দেখেন তিনি নেই। সেখানে আছেন টাকাওয়ালা নেতা।
তারপরও আমি অবশ্যই চাল চোরের বিচার চাই। চাল চোরেরা চুরি না করলে দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক বেশি সহজ হতো। তারা সব ভালো প্রচেষ্টাকেই ধ্বংস করে দয় এবং দিচ্ছে। এই চাল চোরেরা শুধু জনগণের শত্রু না, এরা মানবতার শত্রু-সরকারেরও সবচেয়ে বড় শত্রু। যে কারণে আমি সবার আগে এই চোরদের কঠোর বিচার চাই। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সস্তা তালি পাওয়ার থেকে জনগণকে সঠিক তথ্য, তথা সত্যটা জানানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ সময়। রাজনৈতিক বিরোধ নয়, প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। ভয়াবহ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায়ও যদি আমরা এই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে জাতি হিসাবে আমাদের অনকে বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে, চুরিটা করছে চোরেরা। এদেশে সব জায়গায় চোর আছে। প্রতিটি পেশা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই তাদের অবস্থান শক্তিশালী। রাজনীতিতেও চোর আছে, প্রতিটি দলেও চোর আছে। তারা আমাদের কারণেই ক্রমান্বয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। সামাজিকভাবেও তাদের বর্জন করতে হবে। সবাইকে অনুধাবন করতে হবে, যে দলই তাদের মনোনয়ন দিক না কেন একবার যদি জনগণ সম্মিলিতভাবে তাদের বর্জন করতে পারে তাহলে দেখা যাবে রাজনৈতিক দলগুলোও বাধ্য হবে এদের বর্জন করতে। সাময়িক সস্তা জনপ্রিয়তার পক্ষে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক প্রস্তুতির যে ঘাটতি আছে তা জাগিয়ে তুলতে হবে। তাহলেই সম্ভব পরিবর্তন। তা না হলে এই একই ঘটনা ঘটতে থাকবে বারংবার। অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না।
লেখক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক। মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ