করোনা ভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস। এটি প্রতিনিয়ত এর জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে বিধায় বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরাও এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ার কল্যাণে দেশের প্রায় শিক্ষিত সকল নাগরিকই জানে, এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হলো আরটি-পিসিআর পদ্ধতি। এই আরটি-পিসিআর পদ্ধতিটি আর ১০টি সাধারণ ডায়ানগোনস্টিক টেস্টের মতো নয়। এটি একটি উচ্চ প্রযুক্তির মলিকুলার পদ্ধতি এবং শুধুমাত্র বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্টরাই তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক থেকে প্রশিক্ষিত। এখন পর্যন্ত দেশে যে কয়টি আরটি-পিসিআর ল্যাবে করোনা টেস্ট হচ্ছে, প্রায় সবকয়টিতেই আরটি-পিসিআর স্থাপন, এর ক্যালিব্রেশিন থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষায় ঢাকা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে স্নাতোকত্তর ডিগ্রিধারীরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। দেশে বায়োকেমিস্টদের সংগঠন গ্র্যাজুয়েট বায়োকেমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দেশের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রায় ১০০ জন মলিকুলার বায়োলজিস্টদের যারা আরটি-পিসিআর বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাদেরকে কোভিড-১৯ এর জিনোমিক প্যাটার্ন সর্ম্পকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। দেশের এ মানবিক বিপর্যয়ে তাদের এগিয়ে আসাটা অবশ্যই প্রসংশনীয়।
বর্তমান সরকার প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। বিগত কয়েক বছরে দেশের অনেক জেলায় মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু যারা স্বাস্থ্যখাতের পলিসি নির্ধারণ করেন তাদের বুঝতে হবে যে, শুধুমাত্র ডাক্তার-নার্সরাই চিকিৎসা সেবার সবকিছু নয়। সঠিক চিকিৎসার জন্য সঠিক ডায়াগনস্টিক জরুরি। আর এ কাজে জড়িত বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্টদের ভূমিকাই মুখ্য।
আজকে করোনার এই ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের স্বাস্থ্যখাতের কতটা সংস্কার প্রয়োজন। আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখি, জেলা- উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম পড়ে আছে, সেগুলো চালানোর মতো কোন বিশেষজ্ঞ নেই। আজ হয়ত বিদেশ থেকে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে পিসিআর মেশিন কিনে স্থাপন করলাম, কিন্তু কে সম্পাদন করবে উচ্চ প্রযুক্তির এই আরটি-পিসিআর প্রক্রিয়া?
বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাণরসায়নবিদ, অনুজীববিজ্ঞানী, বায়োটেকনোলজিস্ট স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করছেন। কিন্তু গবেষণাধর্মী এসব বিষয় থেকে যারা পাশ করে বের হচ্ছেন, তাদের জ্ঞানকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য মানসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কয়টি আছে আমাদের? একমাত্র আইসিডিডিআর’বি- তে কিছু ছেলেমেয়ে কাজের সুযোগ পাচ্ছে এবং তাতেই আইসিডিডিআর’বির সুনাম দেশ বিদেশ ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে না পারায় এদের প্রায় ৮০% বিদেশগামী হচ্ছেন এবং তাদের মেধা দিয়েই তারা ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত গবেষণাগারগুলোতে গবেষণা করছেন। এসব দেশে অবস্থানরত আমাদের বন্ধুবান্ধবদের গবেষণাকর্ম নিয়মিতভাবে পৃথিবীর বিখ্যাত সাময়িকিগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। যারা বিভিন্ন কারণে বিদেশমুখী হয় না, তারাও একসময় বিসিএস এবং অন্যান্য সরকারি চাকরিতে চলে যায়। অথচ যে বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করলাম সেগুলো প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির সাবজেক্ট এবং সর্বোচ্চ মেধাবীরাই এসব বিষয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। যাদের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, জিনোম নিয়ে গবেষণা করে দেশের বিজ্ঞান ও চিকিৎসাক্ষেত্রে অবদান রাখার কথা, তারাই অনুরূপ অবদান রাখছে, কিন্তু সেটি জাপান, ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়।
তাই করোনার এই মহামারিতে সময় এসেছে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার নিয়ে ভাবার। প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে চালু করা হোক মলিকুলার রির্সাচ ডিভিশন, যেখানে গবেষণা করবে বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্টরা। গবেষণা হবে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার জিনোম নিয়ে, মানবদেহে এদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে, প্রতিরোধী ড্রাগ/ভ্যাকসিন ডিজাইন নিয়ে। তাহলেই দেশ, দেশের মানুষ এর সুফল পাবে।
বিগত ১৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি আশ্চর্যজনক যে, এ কমিটির সকলেই ডাক্তার। যে করোনা ভাইরাসের জিন, আরটি-পিসিআর, ভ্যাকসিন নিয়ে এত আলোচনা, সেখানে বর্ণিত কমিটিতে নেই কোনো মলিকুলার বায়োলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের পলিসি নির্ধারকদের এটি বুঝতে হবে যে, শুধু চিকিৎসকদের দিয়ে স্বাস্থ্যখাত উন্নত করা সম্ভব না। এর সাথে জড়িত গবেষকদেরও সংক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশ বিদেশে সমান পরিচিত জিন বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হাসিনা খান, প্রফেসর ড. জেবা ইসলাম সেরাজ, প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, টিকাবিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসি কাদরী, ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির প্রধান কারিগরী উপদেষ্টা প্রফেসর ড. শরীফ আখতারুজ্জামান, প্রফেসর ড. এমরান কবীর চৌধুরী কিংবা প্রফেসর ড. হোসেন উদ্দিন শেখর, এদের যে কেউ অনায়াসেই উক্ত কমিটিতে থেকে মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারতেন।
এদের মধ্যে জিন বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হাসিনা খান বাংলাদেশের সোনালী আঁশ পাট এবং জাতীয় মাছ ইলিশের জিনোম নকশা উন্মোচনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন এবং গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৯ সনে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। অন্যান্যরাও গবেষণা কার্যক্রমে অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের মতো সকল মলিকুলার বায়োলজিস্টদের প্রত্যাশা, নবগঠিত পরার্মশক কমিটি উপরোল্লিখিত বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে কাউকে জাতীয় পরামর্শক কমিটিতে কোঅপ্ট করবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার করোনার বিস্তার রোধে সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রায় প্রতিদিনই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। জাতির এই ক্রান্তিকাল উত্তোরণে চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি এ সংক্রান্ত গবেষকদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের মহামারি দেখা দিলে আমরা যেন সেটি আরো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারি, সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যখাতের যৌক্তিক ও কার্যকর সংস্কারের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গবেষণাধর্মী স্বাস্থ্য বিভাগ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট, জয়েন্ট কমিশনার অব কাস্টমস (২৮তম বিসিএস)