ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন মেডিক্যাল অফিসারের অসহায়ত্ব ও দুর্দশার করুণ চিত্র

|
আপডেট: ১৭৫৫ ঘণ্টা, মে ৯, ২০২০
একজন মেডিক্যাল অফিসারের অসহায়ত্ব ও দুর্দশার করুণ চিত্র ডা. তৈয়বুর রহমান গালিব

ইমার্জেন্সিতে ছিলাম। ছয়মাস বাড়ি যাইনি। সেই যে সরকারি চাকরি পেলাম, আর ছুটি নেই। করোনার সময় থেকে একদিন জীবনের নিরাপত্তা পেলাম না। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আমার পোস্টিং। আজ টানা আঠারো ঘণ্টা ডিউটি ছিল। বিকেল ৩টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা। এক রোগী এসে বললো, স্যার একটা ওষুধ, একটা লিখছে, দোকানি আরেকটা দিছে। নার্সরা চেঞ্জ করে আনতে বলছে। চেঞ্জ করতে গেলে দোকানি বললো, বিক্রি জিনিস ফেরত হয় না।

আমি বললাম, আবার যান, বলেন ইমার্জেন্সি ডাক্তার বলছেন।

ওই গরীব রোগী আবার গিয়েও ওষুধ চেঞ্জ বা টাকা ফেরত পেল না।

আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। নিতান্ত গরীব মানুষ। কত কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছে।

আমি বললাম, এটা ত ঠিক না। চলেন তো দেখি।

হাসপাতালের উল্টো পাশেই দোকান। ইমার্জেন্সিতে একজনকে বসিয়ে ওই দোকানে গেলাম।

দোকানে একজন লম্বা মানুষ। পাশে আরেকজন। জিজ্ঞেস করলাম, ওষুধটা সম্ভব হলে বদল করে দেন।

দোকানের মালিক বললেন, বিক্রি জিনিস আমরা ফেরত নিই না। আমি বললাম, দেখেন গরীব মানুষ। আর যে ওষুধ লিখেছে, ওইটা তো দেন নাই। দোকানি ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন, আপনি কে?

- আমি ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার।
উনি তাচ্ছিল্য করে বললেন, ও কমিশন খেতে আসছেন?
আমি বললাম, দেখেন টাকাটা ফেরত দেন ওষুধ না থাকলে।
দোকানি চিৎকার করে উঠলেন, বাড়ি কই আপনার?
আমি বললাম, ফরিদপুর।
-ফরিদপুর হয়ে সাতক্ষীরায় রংবাজি করেন!
বলেই আমাকে বুকে একটা ধাক্কা দিলেন।
এরপর বললেন, আমাকে চিনেন? যান যান। ক্যাশে টাকা নাই।
আমি বললাম, এত বড় দোকানে ক্যাশে টাকা নেই? দ্বিতীয়বার ধাক্কা দেওয়ায় আমার একটা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলো।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধকে বললাম চলেন যাই।
তখন বাজে ৫টা। আমি ইমার্জেন্সিতে এসে সাড়ে পাঁচটায় সিভিল সার্জন স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন ইফতার শেষে কথা বলবেন।
ইফতার শেষে আবার ফোন দিলাম, উনি বললেন দোকানি বেশ ক্ষমতাশালী।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
স্যারকে বললাম, তাই বলে আমাকে মারবে!
উনি বললেন, তুমি থাকো। আমি দেখতেছি।
আমি এরপর আরও কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু ৯টায় আমার ইভিনিং ডিউটি শেষ হবার আগে পর্যন্ত তিনি আমাকে দেখতে আসেননি।
আমার প্রতিষ্ঠানের আরএমও হাসপাতালেই ছিলেন। তিনিও একবারও আমাকে দেখতে আসেননি।

আমি আহত হৃদয়ে ইমার্জেন্সি থেকে ৯টায় বের হয়ে আসি। এরপর খেয়াল করলাম, জামার দুইটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে।

আমি ছোট একজন মেডিক্যাল অফিসার। এজন্য আমার খোঁজ নিলো না। জানি একজন বড় সিভিল সার্জন আমি নই। তাকে মারলে হয়ত দুনিয়া উল্টে যেত। হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেত। আমার জন্য কিছুই হয়নি। সবই চলছে। হয়ত কালও চলবে।

এই তো সেদিনও মা ফোন দিয়ে বললেন, তুমি বাসায় চলে আসো।
আমি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে বলি, আর যে কবে দেখা হবে!
আম্মা আবেগি কণ্ঠে বলেন, কাজ করতে হবে না। তুমি বেঁচে থাকো। ছোট ছেলেটা দেশের বাইরে। তোমার কিছু হয়ে গেলে...
শুনি আর হাসি। এক জীবনে এমন কতো ভালোবাসা যে আমাদের ঘিরে থাকে, আমরা তা টেরও পাই না।

আমি ধরা গলায় বলি, চলে আসবো ঠিক একদিন দেইখেন। বলেই বুকে ধক করে ওঠে। মনে ভয় জাগে, যদি না ফিরতে পারি! যদি এমন হয় আমার কাছে আমার মা কে আসতে না দেওয়া হয়! আঞ্জুমানের কাছে চলে যায় দেহটা! বাবার সাথে শেষ দেখাটা নাও তো হতে পারে।

কিন্তু শত ভয়ের মধ্যেও আমরা ডিউটি করি।

আমার একজন বড় ভাই ছিল। দুই বছর বয়সে হাইড্রোকেফালাস নিয়ে মারা গেছেন। আজ ভাবি, তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত এভাবে মার খেতে হতো না। দুঃখ একটা আমার ঢাকা মেডিক্যালের বড় ভাই, যিনি আমার সিভিল সার্জন, তাকে আমি বড় ভাই বলতে পারলাম না। চার ঘণ্টায় তিনি এক কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে বসে আমাকে দেখতে আসেননি।

আমার জীবনে আমি প্রথমবারের মত নিজের বড় ভাইকে মিস করলাম। একসময় দেখেছিলাম, বাংলাদেশ নামের দেশটির বেশির ভাগ শিশুরই রাস্তায় জন্ম হয়। কোন পিতামাতা থাকে না?

আজ জানলাম, আমি একজন সরকারি মেডিক্যাল অফিসার। আমারও কোন পিতামাতা নেই।

হয়ত করোনার এই দিনে আর কোনদিন বেঁচে থাকব না। কিন্তু জেনে গেলাম, এদেশের সবার জীবনের মূল্য আছে বলেই আমি ঈদের ছুটি পাইনি। কিন্তু আমার জীবনের মূল্য নেই।

মাগো, ভাল থেকো, জেনে রেখো, তোমার ছেলে বলে কেউ নেই। যেদিন সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়েতের সঙ্গে কাজ করতে এসেছি, সেদিন থেকে তোমার আর কোনো ছেলে নেই। মরে গেছে।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

লেখক: মেডিক্যাল অফিসার, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।