চট্টগ্রামের জেলা-উপজেলায় ৫০ জনের অধিক চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলোজিস্ট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন সিএমপির ৩ জন পুলিশ সদস্য।
এই ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিবারের সঙ্গে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের শুরুতে রাখা হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন হোটেল আল ইমামে এবং পরবর্তীতে আসকার দিঘীর পাড় এলাকার আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এরপর নগরের আরও তিনটি আবাসিক হোটেল স্টেশন রোডের ‘হোটেল দি এলিনা’, ‘হোটেল এশিয়ান এসআর’ ও হোটেল প্যারামাউন্ট রিকুইজিশন করা হয়। পুলিশ লাইন থেকে এর মধ্যে বেশ কয়জন সদস্যদের নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়, পতেঙ্গায় র্যাব-৭ পরিচালিত এলিট হলকে তাদের সদস্যদের জন্য আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে করোনা আক্রান্ত সাংবাদিকদের জন্য এখনও কোনো আলাদা আইসোলেশন সেন্টার বা বাসস্থান স্থাপন করা যায়নি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল, দুটি চার তারকা হোটেল আছে। ২০১৫ সালে প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল হিসেবে যাত্রা শুরু করে র্যাডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ। এখানে আছে বিশাল লবি, রয়েছে ২৪১টি রুম, তিন হাজার অতিথি ধারণক্ষমতার দুটি ব্যাংকুইট হল, পাঁচটি ভিন্নমানের রেস্টুরেন্ট।
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রামের প্রথম তারকা হোটেল ‘হোটেল আগ্রাবাদ’-এ মোট ১০১টি লাক্সারিয়াস রুম ও স্যুট রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের অ্যালায়েন্স হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড আগ্রাবাদে সেনাকল্যাণ সংস্থার ২০ তলা ভবনে চালু করেছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের হোটেল ‘বেস্ট ওয়েস্টার্ন’। হোটেলটিতে কক্ষ রয়েছে ৮৮টি। পাশাপাশি পেনিনসুলা ও ওয়েল পার্ক হোটেল ছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী নগরে মাঝারি মানের হোটেল আছে আরও ১৪টি। এসব হোটেলের অধিকাংশই এখন কাস্টমার শূন্য।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ছয়টি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবাদানকারী সদস্যের জন্য নির্ধারিত ১৯টি হোটেলের মধ্যে এখন পর্যন্ত শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘হোটেল অবকাশ’ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্যমতে, সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৮ জন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট মহানগর ও রেঞ্জে পুলিশে ১০০ জন সদস্য আক্রান্ত। এরমধ্যে মহানগরে ১২ জন এবং তিন জেলায় ৮৮ জন। আক্রান্তদের মধ্যে আরআরএফ সদস্য ৬ জন। আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়েছেন ১৩ জন। সংবাদকর্মী ৪ জন। এরমধ্যে ৩ জন সিলেট জেলায় এবং একজন মৌলভীবাজারে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন এক চিকিৎসকসহ ১৬ জন।
সিলেটে করোনা রোগীদের চিকিৎসক ও নার্সদের থাকার জন্য সদর উপজেলার খাদিমনগরস্থ বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বিআরডিটিআই) রেস্ট হাউজ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ সরকারি আরো কয়েকটি রেস্ট হাউজ তাদের আবাসনের জন্য চূড়ান্ত করার কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় এখন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭৬৬ জন। এর মধ্যে কোনো সাংবাদিক না থাকলেও এক পুলিশ উপপরিদর্শক, দুই পুলিশ সদস্য রয়েছেন। মারা গেছেন ৫ জন। ৫ জন মৃতের মধ্যে ওই পুলিশ উপপরিদর্শকও রয়েছেন। রাজশাহী পর্যটন মোটেল, পোস্টাল অ্যাকাডেমি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের হাই সেকেন্ডারি হোস্টেল, রাজশাহী নার্সিং কলেজের নতুন ভবনের হোস্টেল ও আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল স্টাফ-কোয়ার্টারের ৬ ও ৭ নম্বর বিল্ডিংয়ে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা থাকেন।
খুলনা শহরে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন ১০ জন। পুলিশ সদস্য ১৫ জন। জেলায় চিকিৎসক ৪ জন ও স্বাস্থ্যকর্মী ৬ জন। কোন সংবাদকর্মী করোনায় আক্রান্ত নেই। করোনাকালীন হোটেল রয়্যাল ও হোটেল মিলিনিয়ামে চিকিৎসক, হোটেল রোজ গার্ডেনে পুলিশ, আভা সেন্টারে নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। হোটেল ডিএস প্যালেস প্রস্তুত রাখা রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত সেটি ব্যবহার করা হয়নি।
বরিশাল বিভাগে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে কর্মরত ১২ জন চিকিৎসক (ইন্টার্ন চিকিৎসক ৪ জন), ১৫ জন নার্স, ১ জন নার্স সুপারভাইজার, ১ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ১ জন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ১ জন স্টোরকিপারসহ সর্বমোট ৩১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া বরিশাল জেলা পুলিশের ৩ জন সদস্য, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ১ জন সিভিলসহ ৪৬ জন সদস্য, পুলিশ সদস্যদের পরিবারের ৮ জন সদস্য এবং ১ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। সেখানে চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট করোনাযোদ্ধাদের জন্য সাতটি আবাসিক হোটেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- গ্রান্ড পার্ক, হোটেল সেডোনা, হোটেল এরিনা, হোটেল এথেনা, হোটেল ইস্টার্ন, হোটেল আলি এবং রোদেলা।
উদ্বেগের বিষয় হলো, সারাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৪২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। করোনাযোদ্ধাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়। আরও জোরালোভাবে তাদের নামতে হবে যুদ্ধে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ করে রাখাও সম্ভব নয়। জীবন-জীবিকার স্বার্থে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করতে হবে। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে ঘরে থাকার মেয়াদ আর না বাড়িয়ে আগামী ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খোলা রাখা ও গণপরিবহন চলতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এসময়টাতে ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের জন্য হোটেল-মোটেলগুলোতে সরকারি উদ্যোগে আরও বেশি অস্থায়ী বাসস্থান সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সিঙ্গাপুরের কথা। সে দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলো স্বাভাবিক সময়ে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এসব হোটেলে রাখা হয়েছে বিদেশি কর্মীদের, আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। ব্যয়বহুল হোটেলগুলোতে তাদের থাকা-খাওয়ার সব টাকা দিচ্ছে সরকার। সিঙ্গাপুরের অধিকাংশ হোটেল এখন কোয়ারেন্টিন সেন্টারের মতো।
এদিকে প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেছেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই, তাই সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সুস্হ রাখতে খুব দ্রুত পৃথক আইসোলেশন সেন্টার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালযের যৌথ উদ্যেগে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
যদিও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে এ রোগে আক্রান্তদের জন্য আলাদা কেন্দ্র এবং চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভবন ও যানবাহন রিকুইজিশনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে শুধু সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার অপেক্ষায় না থেকে সমাজের বিত্তবান হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা এগিয়ে এলে করোনাযোদ্ধারা পাবেন মনোবল, বাসস্থান নিশ্চিত হলে এই যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ হবে আরও আন্তরিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০২০
টিসি