করোনা কালের কিছুদিন আগেই সুইডিশ কন্যা গ্রেটা থুনবার্গের মাধ্যমে পরিবেশ আন্দোলন বেগ পেয়েছিল অনেকদিন পর। শুরু হয়েছিল শিশুদের নিয়ে 'ফ্রাইডে ফর ফিউচার' নামক পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মসূচি।
করোনার কারণে এখন পৃথিবী নিজেই থেমে গেছে। এর আগেই আমাজন আর অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে পুড়ে ছাড়াখাড় বৃক্ষ আর প্রাণীকূল। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন যখন জ্বলছিল, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তখন ‘বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’। এই নিয়ে মিডিয়া কম জলঘোলা করলো না। আর এইসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জলবায়ু চুক্তি ত্যাগের ঘোষণা দিলেন। এতো গেল বৈশ্বিক নাটকীয়তা।
আমরা সকলেই অবগত যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এগিয়ে বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ছে যার ফলে এদেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে পঞ্চাশ বছরে। পৃথিবীর অনেক সমুদ্রোপকূলবর্তী দেশই এরকম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই বিষয়টিই পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অন্যতম বিষয়।
করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা থমকে গেছে, বহু কলকারখানা বন্ধ ছিল, যানবাহন চলাচল কমে গিয়েছিল। যার ফলে প্রকৃতি আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করলো। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতে ডলফিনের খেলা দৃশ্যমান হলো, স্বচ্ছ আকাশে নক্ষত্রের দেখা মিলল, ঢাকার বায়ুমান একলাফে উন্নতির দিকে গেল। বর্জ্য কমে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গার পানির গন্ধ কমে গেল। লাল কাঁকড়া আর প্রবালের ঝাঁকে ভরে গেল সেন্টমার্টিন। সারা পৃথিবীতেই প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেল। প্রাণীকুল মানুষ আর যান্ত্রিক সভ্যতার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে শুরু করলো।
এর মধ্যে খবরে এলো হালদা নদীতে ডলফিন হত্যার ঘটনা। মানুষ কি নির্মমভাবে তার বাস্তুতন্ত্রকে (ইকোসিস্টেম) ধ্বংস করছে! আর ভারতের কেরালায় মা হাতিকে হত্যার ঘটনা পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুললো। প্রশ্নবিদ্ধ হলো মনুষ্যত্ব। প্রকাশিত হলো প্রাণী হত্যা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসা।
এবার আরেকটি বিষয়, আমাদের দেশে যখনই সড়ক উন্নয়ন বা বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে তখনই কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে প্রচুর বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন ছোট বড় প্রকল্পের কারণে বন উজারকরণ চলছে যা গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নির্মাণ এবং ঢাবিতে মেট্রো স্টেশনের কারণে প্রচুর শতবর্ষী বৃক্ষ নিধন হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা চললেও গঠনমূলকভাবে কিছু হচ্ছে না। এখানে রাজনীতি থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষ কেউই উন্নয়ন বিরোধী নয়, মূলত সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই প্রকল্প হাতে নেওয়ার জন্য। প্রকল্প শেষে অথবা মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপক বনায়ন প্রকল্পও রাখা উচিত। এতে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ থাকে।
উপড়ের ভালো ঘটনাগুলোর সাথে যেমন মানুষ সম্পর্কিত ঠিক খারাপ ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী এই মানুষই।
সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস বেড়েই চলেছে বঙ্গোপসাগরে। পরিবেশ বিপর্যয়ের সাথে দুর্যোগের মেলবন্ধন রয়েছে। কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে যার ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আর সাথে যুক্ত হয়েছে মান্ধাতার আমলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যা নদী ও সাগর দূষণের জন্য দায়ী। প্লাস্টিক দূষণ বাড়ছে যা মানবপ্রজাতির জন্য হুমকি বয়ে আনবে। করোনাকালে স্বাস্থ্য উপকরণ ও কেমিক্যালের ব্যবহার বেড়েছে। এর সাথে বেড়েছে মেডিক্যাল বর্জ্য। এই বর্জ্য অপসারণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি যার ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
পরিবেশগত নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাপী নানা প্রটোকল গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা বেগ পায় না এই কাজে। কারণ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো বেশিরভাগই উন্নত দেশের কাতারে। বিশ্বব্যাপী আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণ ও ব্যবসায় জড়িত পশ্চিমা বিশ্ব। পরমাণু সমৃদ্ধকরণ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্ত্রের খেলায় দায়ী পশ্চিমা বিশ্ব। এই সব অস্ত্র ও বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বেশি উৎপাদনের জন্য। যার ফলে পরিবেশগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং কার্বণ নিঃসরণ বাড়ছে।
এবার আসি বায়ুদূষণ নিয়ে। করোনাকালের আগে দিল্লি আর ঢাকার বায়ুর মান ছিল সর্বনিম্ন, যা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মতো। দুষিত বায়ু যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তেমনি প্রাণীকুলের জন্যও। বায়ুদূষণে রয়েছে সর্বাধিক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি।
উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে তেলভিত্তিক শক্তি উৎপাদন থেকে সরে আসছে। কিন্তু তারা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে তেল গ্যাসের ব্যবসা বহাল রাখছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি টেকসই বিশ্ব বিনির্মাণে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে।
বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ কল্পে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে বদ্বীপ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যার কিছু কাজ এগিয়েছে। 'জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮' প্রণীত হয়েছে। কিন্তু একই সাথে সরকার নদী দখল, বনদস্যুতা ও ইটভাটা ব্যবসা কমাতে পারেনি। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে জীব বৈচিত্র সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
সরকার এ প্রেক্ষাপটে 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২' প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এর প্রয়োগ কতখানি তা প্রাণী নিধনের ঘটনাগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য 'সময় এখন প্রকৃতির'। এবারের আয়োজক আমাজনঘেঁষা দেশ কলম্বিয়া। হয়তো আমাজনের জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ সচেতনতার জন্যই দেশটাকে বেছে নেয়া হয়েছে।
এখন আসি প্রজন্মের দায় নিয়ে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মের দায় রয়েছে। আমরাই পারি বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ও জলবায়ুকে রক্ষা করতে।
সরকারের সহযোগিতায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ শিল্পায়ন করতে হবে। আর আমাদের কাজ হলো যথাসম্ভব প্লাস্টিকপণ্য পরিহার করা। দেশব্যাপী বনায়ন প্রকল্প জোরদার করা। প্রণোদনা দিয়ে হলেও তরুণদের এ কাজে উৎসাহিত করা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃক্ষরোপণ ভূমিকা রাখতে পারে। নদীদখলকারী, বন্যপ্রাণীহরণকারী, বনদস্যুদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
শহরে বনায়ন প্রকল্প বৃদ্ধি করতে হবে। তেলভিত্তিক জ্বালানিনির্ভর যানবাহন কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শহরের পাশে কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগার গড়ে তলতে হবে। পাটের তৈরি ব্যাগের প্রচলন বৃদ্ধি করতে হবে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যাগ পরিহারে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে পুনঃব্যবহার করা যেতে পারে। বিলুপ্তপ্রায় ও বন্যপ্রাণীদের জন্য অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে এবং যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন রক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে সরকার এবং জনগণের। কার্বণ নিঃসরণ কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্বপূর্ণ করতে হবে। পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত রেখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ দুর্যোগে পরিবেশগত ক্ষতিই বেশি হয়।
এছাড়া বহুবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণরা পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ টেকসই বিশ্ব বিনির্মাণে অবদান রাখবে; করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে প্রজন্মের কাছে এই হোক অঙ্গীকার।
ফিরে আসুক শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ, হাজার নক্ষত্রের মাঝে স্বচ্ছ জোছনা কিংবা সুনীল শান্ত সমুদ্র। প্রাকৃতিক নিসর্গের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখুক নতুন প্রজন্ম।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিবেশকর্মী