ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গ্রামীণব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের বঞ্চিত করবেন না

ড. মোহম্মদ ভূঁইয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১২
গ্রামীণব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের বঞ্চিত করবেন না

গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অপসারণ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক ও জটিলতার কথা কম বেশি সবাই জানি। আমাদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে আছি তারা এও জানি, বাংলাদেশ সরকার যে প্রক্রিয়ায় কাজটি সম্পন্ন করে তাতে বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।



সরকারের ভেতর একটি গোষ্ঠী বর্তমানে যেনতেনভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েমে ব্যস্ত। এ জন্য তারা দেশের প্রচলিত সব আইনকানুন উপেক্ষা করছে।

এটাই স্বাভাবিক যে, বোর্ড অব ডিরেক্টরস তাদের নিজস্ব নীতি নিজেরাই নির্ধারণ করবে এবং এ অনুযায়ী গত ২০১১ সালের ২৬ জুলাই বোর্ডের সভায় একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোঁজার ব্যাপারে আলোচনা হয় এবং এ  ব্যাপারে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, অনুসন্ধান কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন ড. ইউনূস নিজে এবং কমিটি গ্রামীণের পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে বের করবে।

গ্রামীণ বোর্ডের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোজাম্মেল হক সভার সভাপতিত্ব করেন। সেখানে এও আলোচনা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালেদ শামস, পরিচালক কামরুল হাসান এবং সদস্যদের থেকে নির্বাচিত পরিচালক রোজিনা বেগম অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন।

কিন্তু এর পরই দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোর্ডের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোজাম্মেল হক  ২২ নভেম্বর ড. ইউনূসকে বাদ দিয়েই ৫ সদস্যবিশিষ্ট অপর একটি কমিটি ঘোষণা করেন। নতুন কমিটির সদস্যদের তিনজনই সরকারি প্রতিনিধি এবং বাকি দু’জন সদস্যদের নির্বাচিত পরিচালক। এটা সরকারি নীতির লঙ্ঘন। যেখানে গ্রামীণব্যাংকে মাত্র তিন শতাংশ মালিকানা নিয়ে সরকার ৬০ শতাংশে কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে। অথচ যে সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের ৯৭ শতাংশের মালিক তাদের অধিকারে আছে মাত্র ৪০ শতাংশ ক্ষমতা। এটা নিশ্চিত ভাবে বিদ্যমান সকল আইন কানুনের লঙ্ঘন।

এটা পরিস্কার যে, এই মহান প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের একজন পুতুল ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্বাচনের জন্যই এই আয়োজন।

নতুন বোর্ডের সভা গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত বোর্ড সদস্যদের বিরোধিতার মুখেও গত ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক ফেব্রুয়ারিতে একটি নতুন বোর্ড নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন স্থগিত রাখেন। কিন্তু অদ্ভূতভাবে চেয়ারম্যান হক কোনও কারণ ছাড়াই আগামী ১৬ জানুয়ারি একটি বিশেষ বোর্ড মিটিং আহ্বান করেছেন। এখন বাংলাদেশের জনগণের খুব সর্তকতার সঙ্গে খেয়াল রাখা উচিৎ, চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক গ্রামীণ ব্যাংকের সাধারণ শেয়ার হোল্ডার বাংলাদেশের  দরিদ্র নারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেন কি না।

এদিকে সরকার বারবার বলছে যে তারা গ্রামীণব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে, সরকার এখন খুবই ঘৃণ্যভাবে সেখানে হস্তক্ষেপ করছে এবং এরই মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানটি লাখ লাখ মানুষকে সহায়তা দিয়ে এসেছে তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

সরকার এবং তাদের তাবেদাররা যে দুর্নীতির খতিয়ান উপস্থাপন করেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, সরকারের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসের বয়সের দোহাই দেওয়াটা শুধুমাত্র তাকে দৃশ্যপট থেকে সরানোর একটা কৌশল। এটাও মনে রাখা উচিৎ- গ্রামীণব্যাংকের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য যে অনুসন্ধান কমিশন গঠন করা হয়েছিল তার নিয়োগ এই সরকারই দিয়েছিল এবং সেই কমিটিও যখন তাদের রিপোর্ট দেয় তখন সেখানে উল্লেখ করে, ড. ইউনূস খারাপ কিছু করেননি।

 সারাবিশ্ব একথা জানে, ইউনূস একজন দূরদর্শী ব্যক্তি এবং এমনই একজন লোক যিনি দরিদ্রদের কথা ভাবার পাশাপাশি খুবই সাধারণ এবং সৎ জীবনযাপন করেন। সরকার  এবং তাদের অনুগতরা এটা ভাল করেই জানে যে, ড. ইউনুস এখানে থাকলে তাদের পক্ষে গ্রামীণব্যাংক এবং এর স্বনির্ভর ও স্বাধীন ৫৪টি সামাজিক ব্যবসার বিশাল সম্পদ গ্রাস করা সম্ভব হবে না। মূলত এ জন্যই তারা ড. ইউনূসকে দৃশ্যপটের বাইরে ঠেলে দেওয়ার জন্য এবং এর অন্য সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে নগ্নভাবে দেশের বিদ্যমান সব আইনের লঙ্ঘন করছে।

সারাদেশে গ্রামীণব্যাংকের ঋণগ্রহীতা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ঋণগ্রহীতা খুবই দরিদ্র এবং তারা সরকারের অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সামর্থ্য রাখে না। এখন এই পরিস্থিতিতে আমি মনে করি, দেশের সব রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং সচেতন নাগরিকেরা সরকারের অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এটাই উপযুক্ত সময়।   গণতন্তের মূল সংজ্ঞা হল, সরকার সব সময়ই জনগণের জন্য জনগণের পক্ষে থাকবে। যদি সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে তাহলে হয়ত সরকার গ্রামীণব্যাংকে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ থেকে সরে আসবে। এর ফলাফল  খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা যায়।
 
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা নিজেদের স্বার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে বিভিন্ন অবৈধ পন্থায়। তবে তাদের জন্য এটাই হতে পারে একটি সুবর্ণ সুযোগ; দেশ এবং জনগণের কল্যাণে কিছু করার।

সরকারের পক্ষে সবচে বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে, গ্রামীণব্যাংকের ওপর থেকে সব ধরনের সরকারি খবরদারির চেষ্টা থেকে সরে এসে এ প্রতিষ্ঠানকে এবং এর অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া। তাদের জন্য এটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ড. ইউনূসকে আবার সসম্মানে ফিরিয়ে এনে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করা। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান বিশ্বের বুকে তুলে ধরা।

একজন মার্কিন-বাংলাদেশি দ্বৈতনাগরিক হিসেবে আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, সরকার অতি দ্রুত ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টি আবারও বিবেচনা করবে। এই ধরনের পদক্ষেপে শুধু বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি এবং গ্রহণযোগ্যতাই বৃদ্ধি করবে না, বরং দেশের ভেতরেও সরকারের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

ড. মোহম্মদ ভূঁইয়া, এনডাওয়েড প্রফেসর অব এন্টারপ্রেনারশিপ ইন ইউএসএ

বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।