ফোন দিলাম চমেক হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটের সদা পরোপকারী হাস্যোজ্জ্বল অনুজপ্রতীম বন্ধু ডা. সন্দীপন দাশকে। বললাম আমার বুকের অস্বস্তির বিষয়টি।
আমার সাবেক সহকর্মী অনুজপ্রতীম অমিত দাশ বললো, দাদা চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই। আমার অফিসের সহকর্মীদেরকে বললাম, আপনারা অফিস সামলান। আমি একটু চেকআপ করে আসি। হাসপাতালের সিঁড়িতেই অমিতকে বিদায় দিলাম। সিসিইউতে যাওয়ার পরই ইসিজি করলেন সিস্টার, তারপর শুয়ে আছি বেডে।
ডা. সন্দীপন এসে ইসিজি রিপোর্ট দেখে বললেন, ‘দাদা তেমন কিছু হয়নি, তবে আপনাকে আমরা কয়েকটা দিন একটু এখানে রাখতে চাই। বললাম, কিছু না হলে কেন হাসপাতালে থাকবো ভাই? মৃদু হেসে আমার ভাইটির উত্তর-‘দাদা, কয়েকটা দিন একটু থাকুন। তারপর বাসায় চলে যাবেন, কোনও সমস্যা নেই। বাসায় বৌদিকে একটু খবর দিন’।
এরইমধ্যে আমাকে একটি বেডে শুইয়ে প্যাথেড্রিনসহ আরও কয়েকটি ইনজেকশন দিলেন সিস্টার। আমি বুঝতে পারলাম, আমার ঘুম আসবে কিছুক্ষণ পরে পেথেড্রিনের প্রভাবে। তাই অগ্রজপ্রতীম বন্ধু দেবাশীষ রায়কে ফোন দিয়ে জানালাম, এ অবস্থায় যাতে সে আমার বাসায় স্ত্রী-পুত্রদের সামাল দিতে পারে। এরই মধ্যে ডা. সন্দীপন এসে বললেন, দাদা, আপনার প্রাথমিক নিরাপত্তার জন্য নাভির কাছে আমারা ৩ দিনে ৬টি ইনজেকশন দেবো। তিনি নিজেই সম্ভবত কার্ডিনেক্স ইনজেকশনটি জোগাড় করে নিজেই পুশ করলেন আমাকে। এছাড়া ডিউটি ডাক্তার ও সিস্টারদেরকে অনুরোধ করলেন যাতে আমার দিকে খেয়াল রাখে। দেড়দিনের মাথায় আমি অনেকটা সুস্থবোধ করছিলাম। দেখলাম অনেক সংকটাপন্ন রোগী সিট পাচ্ছেন না। তা দেখে আমার সত্যিই আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না সিসিইউতে। ডা. সন্দীপনসহ অন্য চিকিৎসকদের অনুরোধ করলাম আমাকে রিলিজ দেওয়ার জন্য। তারা রাজী নন। কিন্তু আমি বুঝিয়ে বলাতে ছাড়পত্র দিলেন। তবে শর্ত-বাকি ৩টি ইনজেকশন বাসায় গিয়ে দিতে হবে নিয়মিত এবং বিছানাতেই বিশ্রাম নিতে হবে।
সেদিন সম্ভবত কোরবানির দিন ছিল। চিকিৎসকদের কাছে অনেক অনুরোধের পর তারা আমাকে হাসপাতাল ত্যাগের অনুমতি দিলেন। তবে শর্ত মানতে হবে তাদের। তথাস্তু। বাসায় চলে এলাম। সেদিন রাতেই এ অধমের বাসায় হাজির ডা. সন্দীপন। নাভির কাছে ইনজেকশন দিয়ে দিলেন। এভাবে তার পরদিনও শত ব্যস্ততার মাঝে সকালে ও রাতে বাসায় এসে শুধু ইনজেকশন দেওয়া নয় সার্বিক বিষয়ের তদারকি করলেন। কে করবে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে- বলুন এ সমাজে?
মানবদরদী চিকিৎসক, চমৎকার বেহালাবাদক, সংস্কৃতিমনা, অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এমন মানুষের সংখ্যাতো অনেক কম। এরপর বিভিন্ন সময়েই এই ভাই-বন্ধুটিকে নিজের জন্য, স্ত্রীসহ পরিবার এমনকি পরিচিতজনদের চিকিৎসার জন্য ফোন করতাম। কোন ধরনের বিরক্তি ছাড়াই সানন্দে উপকার করে গেছে। সম্প্রতি তার শরীর বেশ স্ফীত হয়ে যাচ্ছিল। যত্ন নিতে বললে, বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিতো ‘দাদা চেষ্টা করছি, কিন্তু অনেক মানুষ (রোগী) তো আমার ওপর নির্ভর করে থাকে। তাদেরকে যতটুকু পারি চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টাতো করতে হবে, নাহলে ডাক্তার হলাম কেন?
সত্যিই একজন মানুষ, একজন চিকিৎসক যখন এমন মানসিকতা নিয়ে সমাজে সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করেন তখন আর কিছু বলতে পারি না। শুধু ভালোবাসা- শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। ডা. সন্দীপনের মতো অধিকাংশ চিকিৎসক নিশ্চয়ই এমন মানবিকভাবে রোগীদের প্রতি যত্নশীল।
যারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীদের ঠিকমত চিকিৎসা করেন না, যত্ন নেন না। অন্তত আমি তা বিশ্বাস করি না, মানতে রাজি নই। শুধু ডা. সন্দীপন নয় এমন অনেক চিকিৎসককে আমি দেখেছি যারা কি পরিমাণ আন্তরিকতায়-মমতায়-দক্ষতায় রোগীদের সেবা দিয়েছেন, দিচ্ছেন।
এই মহামারি কোভিড-১৯ এর সময়তো কোনও বিদেশি চিকিৎসক এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন না। আমাদের বাংলাদেশের ডাক্তাররাইতো চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪১ জন চিকিৎসক করোনা রোগিদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ দিলেন। তারপরও আপনারা বলবেন- এদেশের ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন না?
হ্যাঁ, নানা প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, লোকবলের অভাবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে ব্যত্যয় ঘটে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, চিকিৎসকদের সঠিকভাবে স্বাধীনভাবে সুযোগ- সুবিধা দিয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আর্থিক বিষয়টি প্রাধান্য নয়-লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে চিকিৎসাসেবায়। নিরাপত্তা বিধানটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
যে মানবিক চিকিৎসকের কথা বলছিলাম সেই ডা. সন্দীপন হাসপাতালের বেডে সংকটাপন্ন হয়ে শুয়ে আছে। তার সতীর্থ চিকিৎসক, সিনিয়র-জুনিয়ররা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন। গত বুধবার (১৭ জুন) রাতে ডা. সন্দীপনের কথা আলোচনা করতে গিয়ে আমি-আমার স্ত্রী দুজনেই চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আমার শুধু বার বার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে এই ভাইটিকে একটু গিয়ে দেখে আসতে। কিন্তু পরিবেশ- পরিস্থিতি আমাকে অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ অন্তরে ক্ষরণ হচ্ছে তীব্র। বার বার তার প্রাণোচ্ছল হাসিমুখটি ভেসে ওঠে।
ডা. সন্দীপন, ভাই আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন চরম সংকটের সময়। কিন্তু আমি অসহায়। আমি কিছু করতে পারছি না। শুধু শুভ কামনা-প্রার্থনা, আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। আপনার পরিবারের সবাই, বন্ধু-বান্ধব- শুভানুধ্যায়ীরা আপনার সুস্থ হওয়ার অধীর অপেক্ষায়। ডা. সন্দীপন-আপনাকে হাসপাতালের বেডে দেখতে চাই না ভাই। আপনি থাকবেন অসহায়-আর্ত রোগীদের মানসিক শক্তি যুগিয়ে তাদেরকে সুস্থ করার কাজে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ...!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, দৈনিক ভোরের কাগজ।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২০
এসি/টিসি