বর্তমানে আমরা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বৈশ্বিক মহামারির বহুমাত্রিক হুমকির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি। এই দ্বিতীয় সংকটটি সরকারগুলোকে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের হারকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন চাপিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।
করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংকোচনের পূর্বাভাস দিয়েছে। এটি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ সংকট নিয়ে এসেছে। জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিশ্বে সংক্রামিত হয়েছে কমপক্ষে ৮৩ লাখ এবং মারা গেছে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। বহু দেশ জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আওতায় রোগীদের পর্যাপ্ত নিবিড় সেবা প্রদানে কঠিন সংগ্রাম করছে।
কভিড-১৯ মহামারি বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই মহামারিকে জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগের অজুহাত হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। সরকারগুলোর সংকট প্রতিরোধে গণতন্ত্রের নামে নানা ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নীতি প্রয়োগে আগ্রহী হতে পারে। এই মহামারি ট্রলের বিস্তার এবং ভুয়া সংবাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে পেশাদার দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করার প্রবণতার প্রকাশ ঘটাতে পারে। এই সংকট জনস্বাস্থ্যসহ প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্ভরযোগ্যতা ও বৈধতা সম্পর্কেও ব্যাপক সন্দেহকে শক্তিশালী করতে এবং ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক পক্ষগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিতর্ককে প্রশ্রয় দিতে পারে।
করোনা মহামারি মানুষের প্রাকৃতিক মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতাগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যকে বিকল করে কার্যকর জনস্বাস্থ্য পরিচালনার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের নির্দেশনায় এবং নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী নীতির আলোকে স্বাস্থ্যসেবায় রাষ্ট্রীয় সহায়তা হ্রাসের পদক্ষেপের ফলে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাত এই মহামারিজনিত কারণে এখন চরম চাপের মধ্যে রয়েছে।
নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক অঞ্চলগুলোতে নানামুখী প্রভাব রাখছে। ফিলিপাইনে, রাষ্ট্রপতি রড্রিগো দুতার্তে জনসমালোচনার মাঝে রাজধানী ম্যানিলায় বাধ্যতামূলক লকডাউনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ফিলিপিনোদের স্বাস্থ্যসেবা, খাবার এবং আবাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অসমর্থতা আড়ালের চেষ্টা করছেন। দুর্বল রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং তার অভিজাত মিত্রদের সমর্থন নিয়ে দুতার্তে মহামারির বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মধ্যে জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে দ্রুত ম্যানিলায় সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেন। কংগ্রেস অনুমোদিত জরুরি ক্ষমতা ও দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তহবিল নিয়ে দুতার্তে মহামারিবিরোধী জাতীয় টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনজন প্রাক্তন জেনারেলকে নিয়োগ দেন যার মূল উদ্দেশ্য, ফিলিপিনোদের বেঁচে থাকার চেয়ে নিজের রাজনৈতিক বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা। ফিলিপাইনে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে জোরদার করার মতো কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ছিল না, ছিল না শ্রমজীবীদের মৌলিক চাহিদা পূরণের কার্যকর পদক্ষেপ এবং দুতার্তে নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর গঠনমূলক প্রস্তাবেও আগ্রহ দেখাননি। জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে দুতার্তের সামরিকীকরণের কৌশল শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিবাদকে কঠোরভাবে দমন করে এবং গণগ্রেপ্তারের দিকে ধাবিত হয়, যখন ক্ষুধায় লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ফিলিপিনোর অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি।
একইভাবে বহু বছর ধরে সমাজসেবা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী নীতি গ্রহণ ও মহামারির জন্য পদ্ধতিগত ও দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি না থাকার ফলে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া এবং এর বাইরের দুর্বল রাষ্ট্রগুলো একাধিক ফ্রন্টে সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
নয়া উদারনৈতিক উত্তর গোলার্ধে জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিষেবার মতো সাধারণ খাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি হ্রাস করায় করোনা মহামারি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সহজগম্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের হাসপাতাল সেবার অভাবে করোনার কারণে দরিদ্র আফ্রিকান-আমেরিকানদের অধিক হারে মারা যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত শহর ও অঞ্চলগুলোতে ফেডারেল অর্থায়ন করতে এবং মহামারি ফলে দরিদ্র সংখ্যালঘু মার্কিন সম্প্রদায়ের ক্ষতির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছেন। যুক্তরাজ্যে গত দশক ধরে সরকার প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এবং বিভিন্ন জনসংস্থার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে জন্য সামাজিক পরিষেবা খাতে রাষ্ট্রীয় তহবিল হ্রাস করেছে। এইসব তথাকথিত উদারনৈতিক পদক্ষেপ সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, বিশেষত সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর ঝুঁকি বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে।
রাষ্ট্রসমূহ তাদের মূল দায়বদ্ধতা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। এর ফলে অতি ধনী আইকনরা তাদের সম্পদের ভিত্তি প্রসারিত করতে এবং সামাজিক বৈধতাকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন। করোনা মহামারি চলাকালীন বিল গেটস, জ্যাক মা এবং জেফ বেজোসের মতো ধনকুবেরের অতিমাত্রায় পরোপকারী অনুদান তাদের সম্পদ আহরণের সামাজিক বৈধতা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়াসকে উপস্থাপন করে। এর লক্ষ্য, দুর্বল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের চেয়ে বিশ্ব অর্থনৈতির স্বাস্থ্য রক্ষা করা। এই নব্য উদারীকরণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী জনবিনিয়োগ হ্রাস এবং ব্যক্তিসংস্থাগুলোর ভূমিকাকে প্রসারিত করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিন্যাসের পুনর্গঠনের আহ্বান না জানিয়ে ধনকুবেরগণ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাদের নৈতিকতার বাড়াবাড়ি দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করার উপায় হিসাবে পরোপকারের আশ্রয় নিয়েছে।
তারপরও ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, করোনা মহামারি বিশ্ববাসীর সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে ব্যক্তিকে বাণিজ্যিক ও অমানবিক সামগ্রীতে পরিণত করা তথাকথিত নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর। এই বৈশ্বিক মহামারি রাষ্ট্রসমূহের সামনে সৃষ্টি করেছে রূপান্তরকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত জীবন ও মর্যাদাকে অর্থবহ করার, জনস্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী সরকারি বিনিয়োগের এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি পুনর্বিন্যাসের সময়োচিত উপায় অনুসন্ধানের।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ
[email protected]