করোনা ভাইরাস কী, এই কথা এখন আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যে শিশুর মুখে সবেমাত্র বোল ফুটেছে সেও এখন জানে করোনার সময় বেশি করে হাত ধুতে হবে।
কোনো এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখবো পৃথিবী করোনামুক্ত হয়ে গেছে, সেরকম কোনো সম্ভাবনা আসলে নেই। যতদিন পর্যন্ত কোনো সঠিক ওষুধ আর ভ্যাকসিন আবিষ্কার না করা যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিশেষ কোনো হেরফের হবে না। এই অবস্থা আগামী কয়েক বছরেও গড়াতে পারে। এর মধ্য থেকেই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যেতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট। ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে সচেতনতাই হচ্ছে এ থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। কিন্তু যদি কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই যায় তবে এর সমাধান এবং অন্য কোনো সুস্থ্য দেহের মানুষের শরীরে সংক্রমণ বিস্তার রোধে আক্রান্ত ব্যক্তিটির নিজেকে রাখতে হবে আইসোলেশনে অথবা জনবিচ্ছিন্নতায়।
আইসোলেশন বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি, টয়লেট সুবিধা সম্বলিত একটি ঘরে নিজেকে পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। সংক্রমিত ব্যক্তির খাবার ব্যবস্থাও অন্য ঘর থেকে আসবে এবং তার ব্যবহৃত বাসন কোসন জীবাণুমুক্ত হয়ে অন্য ঘরে যাবে। রোগীর পানি পানের মগ, গোসলের তোয়ালে ইত্যাদি আলাদা থাকবে রোগীর নির্ধারিত ঘরে। এইভাবে রোগমুক্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তি নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখবে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশে এখনো অনেক মানুষের জীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আরাম আয়েশের ঘরে থাকার মানুষের চেয়ে এদেশে সুবিধা বঞ্চিত ন্যূনতম বাসস্থান সুবিধার বাইরে বসবাস করে অনেক মানুষ। এছাড়া রয়েছে গৃহহীন মানুষ। আমাদের দেশের খুব বড় একটা অংশের মানুষের বসবাস ঘিঞ্জি বস্তিতে। কিছু কিছু মানুষের আবার দু’কামরার একটি ঘর আছে কিন্তু এখানে সদস্য সংখ্যা আটজন- এমন পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম না। এই অবস্থায় উল্লেখিত মানুষগুলি যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তবে নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি কিভাবে আইসোলেশনে থাকবেন?
আমরা ইতোমধ্যে জানি, তিন তিন তিন এ ফোন করলে টেলিফোনে করোনা ভাইরাস রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। আমার জানামতে এই সুবিধা যারা পেয়েছে তাদের সিংহ ভাগের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, পরামর্শদাতা রোগীকে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেন এবং বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করা হয়। এর অন্যতম কারণটি আমরা জানি, হাসপাতালে আইসোলেশনে রোগী রাখার ব্যবস্থা অপ্রতুল। অসংখ্য সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে কোভিড-১৯- এর চিকিৎসা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা দম বন্ধ করা মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ জীবিকার সন্ধানে। দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর জন্য লকডাউন অথবা ঘরে বসে থেকে হাত ধোয়া একটা অবান্তর ব্যবস্থার নামান্তর। দুবেলা ঘরের বাইরে গিয়ে রিকশার প্যাডেল না ঘোরালে বউ বাচ্চাসহ খেতে পায় না আমাদের রিকশাওয়ালা ভাইটি। তিনি কি করে মানবেন ঘর থেকে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা! তারপর অমোঘ নিয়তির মত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তিনি কোথায় পালন করবেন আইসোলেশন বিলাস!
দিন দিন অবস্থা আরো ভয়াবহ হচ্ছে। বানের জলের মত বেড়ে চলেছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী আর মৃতের সংখ্যা। করোনায় প্রকৃত আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যার হিসাবটাও সঠিক জানা নেই। প্রতিটি রোগ উপসর্গের মতো করোনাও একসময় তার পিক পয়েন্টে পৌঁছাবে তারপর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামবে। কিন্ত সেই পিক সময়টি কখন তা আমরা এখনো জানি না। সকল অনিশ্চিতের মধ্যে বসে থেকে শুধু নির্দেশ মানা আসলে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের পক্ষে বাস্তবিকই সবম্ভব।
ল্যাব টেস্টে নিশ্চিত প্রমাণিত রোগীর জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা না গেলে এই রোগ বিস্তার লাভ করবে শত মাথাওয়ালা মেডুসার মত। আমরা জানি, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে কিন্তু প্রয়োজন আসলে কোনো যুক্তি মানে না। রোগীদের জন্য হাসতাপাতাল সুবিধা এবং আইসোলেশন সুবিধার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে এই গণমৃত্যু ঠেকানো যাবে না। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। অন্যদিকে দারিদ্র হয়ে উঠছে মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর। যেই পরিবারে একটি ঘরে পাঁচজন মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করে সেই পরিবারের কাছে আইসোলেশন টার্মটি একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছু না।
আমরা আরো বেশি সচেতন হই। যতটুকু সম্ভব ঘরে থাকি। স্বাস্থ্য উপদেশগুলো মেনে চলি আর শেষ পর্যন্ত ভালো থাকার চেষ্টাটা চালিয়ে যাই।